সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার। ফাইল চিত্র।
কথায় বলে, নিজের ভাল পাগলেও বোঝে। দেখা যাচ্ছে, কাশ্মীর উপত্যকার মানুষ সে দিক থেকে ব্যতিক্রম! কেষ্ট থেকে বিষ্টু সকলেই জানেন, কিসে কাশ্মীরের ভাল, জানে না একমাত্র কাশ্মীর। তাই তাদের ধরে বেঁধে বোঝানো হচ্ছে, ওষুধ তেতো হলেও খেতে হবে।
যে রবিবার মধ্যরাতে ওমর আবদুল্লাদের গৃহবন্দি (পরে গ্রেফতার) করা হল, সে দিন সন্ধেয় কাশ্মীরের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি মেহবুবা মুফতির বাড়িতে একত্রিত হয়েছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করার চেষ্টা হলে তা মানা হবে না। অর্থাৎ আবহাওয়ার খবরটি পড়তে তাঁরা ভুল করেননি। ঘটনাচক্রে তার ঠিক আগের রবিবার শাহ ফয়জ়ল এবং শেহলা রশিদ কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন এই ৩৭০ নিয়েই কথা বলতে। তখনও ওঁদের ধারণা ছিল না যে, সাত দিনের মধ্যে সব কিছু বদলে যাবে। শাহ ফয়জ়লরা শুধু বলে গিয়েছিলেন, যে রাজ্য (এখন তো রাজ্যও নয়) এত বছর ধরে আফস্পা-র অধীনে রয়েছে, সে বাড়তি সুবিধা-বলে বহাল তবিয়তে আছে, এ কথা মনে করার জায়গা আছে কি? আবার ৩৭০ রদ হলেই কাশ্মীর পর দিন থেকে আমূল বদলে যাবে, সূর্য পশ্চিমে উঠবে, এমনটাও ভাবার কারণ নেই। তা হলে ৩৭০ নিয়ে এই ভাবাবেগ কেন? শাহ ফয়জ়লদের উত্তর ছিল, কারণটা অনেকটাই প্রতীকী। ৩৭০ হল এমন এক সনদ যা কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্তের অংশ। আজ সেটা এ ভাবে বাদ দিলে কাশ্মীরিরা নিজেদের প্রতারিত মনে করতেই পারেন। ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে কাশ্মীরের একটা বড় অংশের সম্পর্ক এমনিতেই বিষিয়ে উঠেছে। ৩৭০ চলে গেলে তাঁদের মনের শেষটুকুও বিষিয়ে যাবে।
শাহ ফয়জ়লরা ঠিক বলছেন না ভুল, তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু ওঁরা যে পাকিস্তানপন্থী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী নন, তাতে সন্দেহের অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। কেন্দ্রীয় সরকারের বয়ান শুনে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, কাশ্মীরের অ-পাকিস্তানপন্থী এবং অ-বিচ্ছিন্নতাবাদী অংশটিকেই তাঁরা কাছে টানতে চান! উন্নয়নের জোয়ারের স্বপ্ন তাঁদের কথা ভেবেই ফেরি করা হচ্ছে! তা হলে সেই তাঁদেরই কাছে সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠার এত বড় রাস্তা খুলে দেওয়া কেন? জনমনের হদিশ সরকার বাহাদুর অনেক ভাল জানে। ৩৭০ নিয়ে কাশ্মীরের আবেগ নিশ্চয়ই তাদের অগোচর নয়। তা হলে তারা কারও সঙ্গে আগাম আলোচনা না করে এমন সিদ্ধান্ত নিল কেন?
সরকারপন্থীরা বলবেন, এ সিদ্ধান্ত তো জনবিরোধী নয়! লাদাখ খুশি, জম্মু খুশি। হইচই করছে শুধুমাত্র কাশ্মীর উপত্যকার কিছু দুষ্টু লোক! তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া গেল তা-ই। কিন্তু শুধু মুষ্টিমেয় দুষ্টু লোকের জন্যই কি তবে এত ধরপাকড় করে, নেতানেত্রীদের জেলে পুরে, অমরনাথ যাত্রা বন্ধ করে, সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্তব্ধ করে, সংবাদমাধ্যমকে আটকে দিয়ে কাশ্মীরকে প্রায় অবরুদ্ধ করে রাখতে হচ্ছে? জাতির উদ্দেশে কাশ্মীরের আশু উন্নয়ন নিয়ে যে বাহারি বক্তৃতা প্রধানমন্ত্রী করলেন, কাশ্মীর নিজেই তো তা ভাল করে শুনতে পেল না। তা হলে লাভ কার?
স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করেই বলা যাক। লাভ কাশ্মীর ছাড়া আর সবার। অন্তত এই মুহূর্তে। বেশ কিছু বছর ধরেই কাশ্মীর কার্যত একটা চুম্বকের ভূমিকা পালন করে চলেছে, যে চুম্বক দিয়ে নিমেষে দেশের বাকি অংশকে এক জায়গায় জড়ো করে ফেলা যায়। কাশ্মীর এমন এক আরক, যার এক ফোঁটা সেবন করামাত্র গোটা দেশের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। কাশ্মীর এমন এক ঘুঁটি, যা দিয়ে ভোট-বৈতরণি পার হওয়া যায় অনায়াসে। সেই কাশ্মীর আজ সবার জন্য অবারিত— ব্যবসা করুন, জমি কিনুন, বৌ আনুন, শুটিং করুন, মন্দির গড়ুন, বেড়িয়ে আসুন— কোনও আহ্বানই বাকি থাকছে না। সব পেয়েছি-র চাবি আজ দেশের হস্তগত। এক মিনিট সবুর করুন, ডান্ডা দিয়ে বাকি সব ঠান্ডা করে দেওয়া যাবে।
অমূলক আশঙ্কা ভেবে উপরের কথাগুলো উড়িয়ে দেওয়াই যায়। কিন্তু সন্দেহের কাঁটা উপড়ে ফেলা যায় না। কাশ্মীরের ভাল চেয়ে এত আয়োজন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা, অমিত শাহের আশ্বাস— এগুলো কি ৩৭০ রদ করার আগে হতে পারত না? একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের জন্য আগাম আস্থাবর্ধক পদক্ষেপ ভাবা যেত না? তুরন্ত ভোটের যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী দিলেন, সেই ভোট করিয়েই তো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে আলোচনায় বসা যেত! নিদেনপক্ষে কাশ্মীরের বাছাই ভূমিপুত্রদের দিয়ে আদালতে ৩৭০-এর রদ চেয়ে পিটিশন করানো যেত! এর কোনওটাই করা হল না। কেন?
সম্ভাব্য কারণ চারটি। এক, সরকার জানত যে কাশ্মীরের প্রতিনিধিদের আলোচনায় শামিল করলে তাঁরা কিছুতেই মত দেবেন না। দুই, আগাম ঘোষণা করে সব করতে গেলে কাশ্মীরে জনআন্দোলন মাত্রা ছাড়াবে। জঙ্গি সক্রিয়তাও বাড়বে। তিন, আলাপ-আলোচনা সময়সাপেক্ষ। কাশ্মীরে আজ না হোক কাল ভোট করাতেই হবে। ভোট যদি এক বার হয়ে যায়, তা হলে নির্বাচিত সরকারকে এড়িয়ে যাওয়ার জো থাকবে না। কিন্তু বর্তমান আসন-বিন্যাসে ভোট হলে বিজেপির পক্ষে একক ভাবে ক্ষমতায় আসা কঠিন। চার, সংসদে সংখ্যা নিয়ে অসুবিধা হবে না। ফলে এত ঝামেলায় যাওয়ার দরকারই নেই।
বলা বাহুল্য, চারটি কারণের একটিও গণতন্ত্রের পক্ষে সুলক্ষণ নয়। প্রথম তিনটির মধ্যে সীমান্তপারের উস্কানির অংশটা বাদ দিলে যা পড়ে থাকে, তার নির্যাস একটাই— জনকল্যাণের এমনই ঘটা যে তাতে না আছে জনের সমর্থন, না আছে জননেতাদের সমর্থন। নইলে এত কড়াকড়ির দরকারই হয় না। হচ্ছে, কারণ কাশ্মীরিরা খুব ভাল করেই জানেন, কল্যাণকামিতায় ছিদ্র আছে। সেই ছিদ্র দিয়ে উন্নয়ন ও আদানপ্রদানের ভেক ধরে ঢুকে পড়বে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। কাশ্মীরের চেহারা আর জনবিন্যাসটাই যাবে বদলে।
চতুর্থ কারণ, অর্থাৎ সংসদীয় সক্রিয়তার উৎসে আছে সংখ্যার জোর এবং জাতীয়তাবাদের তাস যার সামনে বিরোধীরাও প্রায়শ কাত। তাতে গণতন্ত্রের হানি কোথায়? একেবারে মূলে। বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে ভোটে জেতা গণতন্ত্রের একটি ধাপ। কিন্তু সেটাই সব নয়। তা হলে সংখ্যাগুরুবাদ আর গণতন্ত্র এক হয়ে যেত। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত একটি সরকার সংসদীয় কার্যবিধি অনুসরণ করে একটা কাজ করেছে মানেই যে স্বতঃসিদ্ধ ভাবে সেটা গণতান্ত্রিকতার পরাকাষ্ঠা, তেমন না-ই হতে পারে। গণতান্ত্রিক উপায়েই গণতন্ত্র সোক্রাতেসকে হত্যা করেছিল। সেটা গণতান্ত্রিকতার বিজ্ঞাপন বলে গণ্য হয় না। গণতন্ত্রের পাটিগণিতে পাশ হয়েছে বলেই একটা উপত্যকাকে বেয়নেট উঁচিয়ে গৃহবন্দি করে জনদরদের গান গাওয়াটা গণতন্ত্রসম্মত হয় না।
মুশকিল এই যে, গণতান্ত্রিকতা, বিরোধী স্বর, সংখ্যালঘুর রক্ষাকবচ, প্রতিবাদের পরিসর— এই সব শব্দবন্ধই ব্যর্থ পরিহাসে পরিণত হতে বসেছে আজকাল। সংসদে শুধু বিরোধীরাই ছত্রভঙ্গ হননি। নাগরিক সমাজও তার প্রার্থিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ, কারণ সেখানেও সিংহভাগই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র আর একরৈখিক হিন্দুয়ানির নবনির্মিত গৌরবগাথায় বুঁদ। তাই আরটিআই, ইউএপিএ, এনআইএ-র ধারা অনায়াসে বদলে যাচ্ছে। দেশবাসীর গায়ে লাগছে না। তাঁরা অবলীলায় বলে উঠছেন, ৩৭০ চালু হওয়ার সময়ে কি সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছিল? একটা অস্থায়ী অনুচ্ছেদ বাতিল হয়েছে তো কী হয়েছে? এই উত্তরগুলো যে এত হইহই করে সাধারণ্যে মান্যতা পাচ্ছে, তাতে একটা জিনিসই প্রমাণ হয়। গণতান্ত্রিকতা থাকল কী গেল, সেটা এই মুহূর্তে আর খুব দরকারি বিষয়ই নয়। সংবিধানের একটা অনুচ্ছেদ অস্থায়ী হিসেবে চিহ্নিত ছিল বলেই সেটা টুক করে বদলে ফেলার মধ্যে যে গা-জোয়ারি আছে, সেটাও আর তেমন আপত্তিকর ঠেকছে না। কালেদিনে হয়তো এ-ও শুনব, বিয়ে ঠিক করার সময়ে বাবা তো মেয়ের মতামতের তোয়াক্কা করেননি! এখন তাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে ঘাড় ধরে বার করে দিলেই বা কী এমন অন্যায় হবে! অথচ বেশি দিনের কথা নয়, গত বছরের এপ্রিল মাসেই সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি গোয়েল এবং বিচারপতি নরিম্যানের বেঞ্চ বলেছিল, দীর্ঘ দিন যাবৎ অনুসৃত হয়ে আসার পরে ৩৭০ অনুচ্ছেদটি স্থায়ী অনুচ্ছেদের মর্যাদাই অর্জন করেছে। তা রদ করা অসম্ভব। যত ক্ষণ না সুপ্রিম কোর্ট তার অবস্থান পরিবর্তন করছে, তত ক্ষণ তো এটিই মান্য হওয়ার কথা!
কিন্তু আপাতত গণতান্ত্রিক সরকার ও গণতন্ত্রের নাগরিক সমাজের বৃহদংশ ঠিক করে নিয়েছেন, গণতন্ত্র নিয়ে তাঁরা মাথা ঘামাবেন না। জয় হে!