ছবি: এএফপি।
আমপান ঝড়ে চাষের ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব ১২০০ কোটি টাকা। ক্ষতির মূল্যায়ন যত বিশদ হইতেছে, অঙ্কটিও বাড়িতেছে। কিন্তু শেষ বিচারে চাষির বিপন্নতা দিয়া ক্ষতির পরিমাপ করিতে হইবে, কেবল নষ্ট ফসল দিয়া নহে। বিপন্নতার শুরু লকডাউনের সঙ্গে। পরিবহণ বন্ধ হইলে আনাজ পচিয়াছে, মান্ডিগুলি বন্ধ থাকায় চাষিরা ফসলের দাম পাইয়াছেন যৎসামান্য। গোলাপজাম বা জামরুলের ন্যায় দামি ফল মাটিতে মিশিয়াছে। মিষ্টান্ন শিল্প বন্ধ হইবার জন্য প্রতি দিন নষ্ট হইয়াছে কয়েক হাজার লিটার দুধ। এই পরিস্থিতিতে আমপান দক্ষিণবঙ্গের চাষিদের সকল আশা ধূলিসাৎ করিল। পানের বরজ, ফুল ও ফলের চাষ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি আরও বড়। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নোনাজল ঢুকিয়া জমি নষ্ট হইয়াছে। পুকুরের জল দূষিত হইয়া মাছ নষ্ট হইয়াছে। বহু জায়গায় বড় বড় ফলের বাগান সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ। আনাজ, ফল, ফুল, পান বহু চাষির রোজগারের প্রধান উপায়, অথচ সেগুলি ফসলবিমার সুরক্ষা পায় না। বিমার বিস্তার বাড়াইবার সিদ্ধান্ত একাধিক বার ঘোষণা হইয়াছে, কাজ হয় নাই। চাষি শুধু দুর্যোগের কারণে বিপন্ন নহেন, মন্দ নীতির জন্যও বটে। একটি দুর্যোগ পাইয়া যত দোষ, যত ব্যর্থতা, তাহার ঘাড়ে চাপাইলে চলিবে না।
এমন সার্বিক ক্ষতির মোকাবিলা করিতে হইলে এক বহুমুখী পরিকল্পনা প্রয়োজন। চাষির হাতে এখনই পুনরায় চাষ করিবার মতো যথেষ্ট অর্থের সংস্থান করা প্রয়োজন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বরাবরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরে চাষির হাতে ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়াছে বিপর্যয় তহবিল হইতে। এই বারও তেমন হইবে, ইহাই প্রত্যাশা। কিন্তু তাহার সহিত জমি, বাগান, পুকুর প্রভৃতি সংস্কারের জন্য যথেষ্ট কৃষিঋণও পৌঁছাইতে হইবে। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করিয়াছেন, বাড়তি এগারো লক্ষ কিসান ক্রেডিট কার্ড মঞ্জুর হইবে। কিন্তু তাহাতে কেবল জমির মালিকরাই উপকৃত হইবেন। যাঁহারা চাষি, তাঁহাদের একটি বড় জমি ঠিকা লইয়া চাষ করেন। ফলে, ঋণ পাইবার আশা তাঁহাদের নাই। কী ভাবে প্রকৃত চাষির নিকট ঋণ পৌঁছানো সম্ভব, সেই পথ বাহির করিতে হইবে। জমি অনুৎপাদক থাকিলে উপভোক্তারও ক্ষতি। বাজারে অগ্নিমূল্য আনাজ বলিতেছে, খাদ্যসুরক্ষার জন্যও চাষির সহায়তা প্রয়োজন। কৃষি উৎপাদনকে স্বাভাবিক চক্রে যথাশীঘ্র সম্ভব ফিরাইয়া আনা কেবল চাষির স্বার্থ রক্ষার বিষয় নহে, জনস্বার্থের বিষয়।
নির্মলা সীতারামন কৃষি বিপণনের পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য এক লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করিয়াছেন। ২০১৭ সালে অনুরূপ লক্ষ্যে ৬,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হইয়াছিল প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্পদ যোজনায়। তাহার সামান্যই খরচ হইয়াছে। অতএব প্রতিশ্রুতিরক্ষার অপেক্ষা না করিয়া, পরীক্ষিত উপায়ে কৃষি বিপণনে গতি আনা প্রয়োজন। সরকারের ‘সুফল বাংলা’ প্রকল্পটি মধ্যস্বত্বভোগীদের সরাইয়া কৃষি উৎপাদন সরাসরি বাজারে আনিতেছে। চাষির ন্যায্য মূল্য পাইবার সম্ভাবনা বাড়িয়াছে। এই ভাবে প্রত্যক্ষ বিপণনের নানা উদ্যোগকে সরকারি সহায়তা দিতে হইবে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি কার্যত সরকারি সহায়তা হইতে বঞ্চিত। এই বিপর্যয়ে তাঁহাদের নিকট সরকারি সাহায্য পৌঁছাইবার কাজটিই কৃষি সংস্কারের অন্যতম লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন।