অতিমারি হোক অথবা খরা বা বন্যা, যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সাধারণ মানুষের ভাল থাকার গায়ে কতখানি আঁচ লাগবে— তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য কতখানি ভাঙবে, জীবনজীবিকার ক্ষতি হবে কতখানি— তা শুধু সেই বিপর্যয়ের তীব্রতার ওপরই নির্ভর করে না। নির্ভর করে সেই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়ার ওপরও। আমরা কী ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছি, সহনাগরিকদের প্রতি আমাদের মনোভাব কী রকম, অর্থনৈতিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছি, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ওপরে নির্ভর করে মানুষের জীবনে সেই বিপর্যয়ের ধাক্কার তীব্রতা।
বিপর্যয় হিসেবে কোভিড-১৯ এখনও নতুন। আমরা এখনও এই বিপদকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। আমরা এখনও নিশ্চিত ভাবে জানি না যে এর প্রতিক্রিয়ায় কোন আর্থিক সিদ্ধান্তগুলি যথাযথ হবে। তবে মনে রাখা ভাল, নিশ্চিত বলে জীবনে আসলে কিছু হয় না। আমরা নেহাত ভ্রান্তির বশে বেশির ভাগ সময়ই এমন ভাবে বাঁচি যেন মনে হয় যে জীবন আসলে নিশ্চিত। এই ভ্রান্তিটি না থাকলে অবশ্য ঘোর মুশকিল হত।
ইতিহাস আমাদের একটা কথা শিখিয়েছে— যুদ্ধ বা অতিমারির মতো বিপর্যয়ে বহু দেশেরই অর্থনৈতিক গতিপথ সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে পারে। এত দিন যারা জিতছিল, তারা চলে যেতে পারে পরাজিতের দলে। আবার, হেরোরা হয়ে উঠতে পারে নতুন বিজেতা। এই অনিশ্চয়তা আছেই। কিন্তু, তা সত্ত্বেও আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে; অর্থনীতি যাতে যত দূর সম্ভব ঠিকঠাক চলে তা নিশ্চিত করতে হবে; দেখতে হবে, সাধারণ মানুষ যেন অনাবশ্যক কষ্ট না পায়। জাতীয় অর্থনীতি কোন পথে যেতে চলেছে, তার প্রাথমিক আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তার ভিত্তিতে কিছু অনুমান করা সম্ভব।
এই মুহূর্তে প্রধানতম সমস্যাগুলোর মধ্যে একটা হল, ভাইরাসের সংক্রমণ রোধের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অর্থনীতিকে চালু রাখার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারা। ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বোঝা কিছুতেই দেশের গরিব মানুষ, শ্রমিক ও অভিবাসী কর্মীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের পর অর্থনীতির ধ্বংসস্তূপে এসে দাঁড়ানোও কোনও কাজের কথা নয়। তর্কটা আসলে জীবন বনাম অর্থনীতির নয়— তর্কটা হল জীবন বনাম জীবনের।
শুধু কেরল নয়, কোভিড-১৯’এর বিরুদ্ধে গোটা ভারতই যথেষ্ট ভাল লড়ছে। দেশে কোভিড-১৯’এর প্রকোপ এখনও সীমিত। প্রতি এক কোটি মানুষে প্রাণহানির হার এখনও ছ’জন। ইয়োরোপের বেশির ভাগ অংশে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যা চলছে, ভারতের পরিস্থিতি তার চেয়ে ঢের ভাল। স্পেনে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার প্রতি এক কোটি মানুষে ৪,৯৬০ জন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১,৬৭০ জন, ইটালিতে ৪,৪১০ জন, ব্রিটেনে ৩,০৫০ জন, সুইডেনে ২,১৭০ জন।
তবে, মৃত্যুর হার শুধু ভারতেই কম নয়। দেখা যাচ্ছে, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই কোভিড-১৯’এ মৃত্যুর হার কম। প্রতি এক কোটি মানুষে মৃত্যুর হার বাংলাদেশে ৯ জন, শ্রীলঙ্কায় ৩ জন, পাকিস্তানে ১০ জন, কেনিয়ায় ৩ জন, তানজ়ানিয়ায় ২ জন, নাইজেরিয়ায় ২ জন। ইথিয়োপিয়ায় এই হার মাত্র ০.৩ জন।
রোগের ব্যাপকতার মাপকাঠি হিসেবে তাতে মৃত্যুর সংখ্যা দেখা ভাল। কারণ, কত জনের সংক্রমণ হচ্ছে, তার চেয়ে কত জন মারা যাচ্ছেন, সেটা বেশি নিখুঁত ভাবে হিসেব রাখা সম্ভব। মৃত্যুর পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাচ্ছে, ইউরোপ বা আমেরিকার সঙ্গে আফ্রিকা-দক্ষিণ এশিয়ার ফারাক বিপুল। কেন, তা এখনও নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি। আফ্রিকা বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অবশিষ্ট দুনিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন, সে কথা মোটেই বলা যাবে না। বাংলাদেশিরা দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠীর একটি। ইথিয়োপিয়ার সঙ্গে চিনের আর্থিক সংযোগ জোরদার। কিন্তু দুটো দেশেই কোভিড-১৯’এ মৃত্যুর হার খুব কম। পরিস্থিতি যে এ রকমই থাকবে, সেটা ধরে নেওয়া ভুল হবে। কিন্তু একই রকম ভুল হবে এটা ধরে নেওয়া যে ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ যে পথে চলেছে, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি সেই কক্ষপথেরই প্রারম্ভিক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে।
সংক্রমণ ঠেকাতে যুক্তিগ্রাহ্য পদক্ষেপগুলো করতেই হবে। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে ঝুঁকি কখনও একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। জীবনে কোনও কাজই সম্পূর্ণ ঝুঁকিহীন নয়। কাজেই, করোনা-সংক্রমণের ঝুঁকিকে শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ করলে তা আমাদের সমাজ ও অর্থনীতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। বিশেষত গরিব মানুষের জন্য, যাঁদের কোনও সঞ্চয় নেই। সত্যি বলতে, আমার মাঝেমাঝেই ভয় হচ্ছে যে আমরা একটা ফিয়ার সাইকোসিস-এ ঢুকে পড়ছি। তাতে কিন্তু লাভ হবে না।
ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে জিততে হলে রিপ্রোডাকশন নাম্বার বা ‘আর-জ়িরো’-কে ১-এর চেয়ে কম রাখতে হবে। এক জন সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে গড়ে কত জন সংক্রমিত হচ্ছেন, সেই সংখ্যাটিই হল ‘আর-জ়িরো’। কেরলে যেমন এখন ‘আর-জ়িরো’ নেমে এসেছে ১-এর নীচে, তেমনই কোনও অঞ্চলে এই হার একের নীচে নামলে বুঝতে হবে, সেখানে রোগটির প্রকোপ কমতে শুরু করেছে।
কী ভাবে লকডাউন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, দেশের আর্থিক নীতির সামনে সেটা একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ। কাজটা সাবধানে, কিন্তু দ্রুত, করতে হবে। কোন দেশে লকডাউনে কতখানি কড়াকড়ি হচ্ছে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা তার একটা সূচক তৈরি করেছেন। দেখা যাচ্ছে, ৭৩টি দেশের মধ্যে কড়াকড়ির মাপকাঠিতে ভারত এক নম্বরে। অল্প কয়েক দিনের জন্য হলে এই কড়াকড়িতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু, কোনও দেশই দীর্ঘ দিনের জন্য কড়াকড়ির তালিকায় এক নম্বরে থাকতে চাইবে না। এতে গরিব মানুষের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে, দেশের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্বাস্থ্যের খুব ক্ষতি হবে। অন্য দেশ এবং বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা দেশের সম্পদ কিনেও নিতে পারে।
সমীক্ষায় প্রকাশ, ভারতে বেকারত্বের হার ২৪ শতাংশে পৌঁছেছে। সর্বকালের সর্বোচ্চ হার। এই মার্চে এক মাসের মধ্যে যত পুঁজি দেশ থেকে বেরিয়ে গেল, সেটাও সর্বোচ্চ— প্রায় ১,৫০০ কোটি ডলার। গোটা দুনিয়ার ইর্মাজিং ইকনমিগুলির মধ্যে আর কোথাও এত পুঁজি দেশ থেকে বেরিয়ে যায়নি। এর ফলে টাকার দাম কমেছে— সর্বকালের সর্বনিম্ন দরে পৌঁছেছে টাকা। এই অতিমারি-আক্রান্ত সময়ে এই ঘটনাগুলোর কয়েকটা ঘটবে, সেটা প্রত্যাশিত— স্বল্পমেয়াদে এই সমস্যাগুলোকে সামলেও নেওয়া যাবে। কিন্তু, এই ভাবেই যদি চলতে থাকে, তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রফতানি, ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারত অন্য দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে পড়বে, তাদের জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। এবং, তাতে শ্রমিক শ্রেণির অশেষ দুর্ভোগ হবে।
৩ মে লকডাউন উঠলে ব্যবসা চালু করতে দিতেই হবে। বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজ হতে দিতে হবে, বিশেষত অসংগঠিত এবং ক্ষুদ্র শিল্পে। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং, মাস্ক ব্যবহার করা, হাত ধোয়ার মতো নিয়ম অবশ্যই মেনে চলতে হবে, কিন্তু শ্রমিকরা যাতে কাজের জায়গায় যেতে পারেন, কৃষিক্ষেত্রে এবং কারখানায় যাতে নির্বিঘ্নে কাজ চলতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
যে নিয়মগুলো মেনে চলার কথা বললাম, সেগুলো বলবৎ করার ছুতোয় যাতে আমলাতান্ত্রিক ছাড়পত্রের প্রকোপ আরম্ভ না হয়, সেটা দেখতে হবে। ‘লাইসেন্স রাজ’ বস্তুটার হাতে ভারতীয় অর্থনীতির বহু দুর্ভোগ হয়েছে। আমরা জানি, এই নিয়ন্ত্রণের নীতির ফলে হাতে গোনা কয়েকটা বড় সংস্থা বাদে বাকি সব সংস্থার গলায় ফাঁস কত জোরে চেপে বসে। অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির পক্ষে সেই ফাঁস প্রাণঘাতী। কাজেই, সেই পুরনো কু-অভ্যাস যাতে ফিরে না আসে, সে বিষয়ে সাবধান থাকা প্রয়োজন।
সব উন্নয়নশীল দেশই এক মোক্ষম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দুনিয়াভর যে ওলটপালট চলছে, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে কোনও দেশ ভুল পদক্ষেপ করলে সেটা সাধারণ ভুল হবে না। সেই ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ মিলবে না। আজকের একটা ভুল পদক্ষেপ স্থির করে দেবে, আগামী কয়েক দশক দেশের অর্থনীতি কোন কক্ষপথে চলবে।
এই অতিমারির মতো বড় বিপর্যয় এক ধাক্কায় আমাদের চোখ খুলে দেয়। আমাদের মনে পড়ে যে সব মানুষই সমান হয়ে জন্মায়। এই সময়টা আসলে সহানুভূতির, সহৃদয়তার। কুসংস্কার বিসর্জন দিয়ে বিজ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতাকে জায়গা করে দেওয়ার। বাংলা এক কালে গোটা এশিয়ায় নবজাগরণের পথিকৃৎ ছিল। এখানে বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষ ঘটেছিল আগে; নতুন নতুন আবিষ্কারের সাক্ষী ছিল বাংলা। এবং, ধর্মনিরপেক্ষতা বা জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে মানবিক সাম্যের নীতির পথেও অগ্রপথিক ছিল বাংলাই। আজকের এই বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার বিশেষ দায়িত্ব আছে— যাবতীয় মতপার্থক্যকে দূরে সরিয়ে রেখে এগিয়ে আসার, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে এই বাংলাকেই।
ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)