স্কুলে মিড ডে মিলের চাল আলু বিলি হচ্ছে। নিজস্ব চিত্র
লকডাউনের জেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে বিদ্যালয়। যে পড়ুয়া মিড-ডে মিলের জন্য বিদ্যালয়ে আসত সে-ও ভুলেছে বিদ্যালয়ের দরজা। অথচ আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জেলার খেটে খাওয়া গ্রাম বাংলার বহু মানুষের সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের একমাত্র জায়গা জেলার সরকারি বিদ্যালয়গুলি। জেলার বিশিষ্ট জনেদের মতে এই লকডাউনের ফলে স্কুল ছুট পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়বে মুর্শিদাবাদ জেলায়। তারই মধ্যে চতুর্থ দফার লকডাউন শেষে রাজ্য সরকারের নির্দেশে ১ জুন থেকে ধর্মীয় স্থানের খিল খুলছে। পাশাপাশি বন্ধ দরজা খুলছে জেলার একাংশ বিদ্যালয়েরও। তবে তা পড়ুয়াদের পড়াশোনার জন্য নয়। আগামী কিছু দিন ওই বিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠবে ভিন্ রাজ্য থেকে ঘরে ফেরা মানুষগুলোর নিভৃতবাস।
যা নিয়ে ক্ষুব্ধ জেলার একাংশ শিক্ষাবিদ। জেলার এক প্রবীণ শিক্ষকরা বলছেন, অতীতে বন্যা, খরা বা যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যাই হোক না কেন, বিদ্যালয় ভবনগুলো সব সময় হয়ে উঠেছে গৃহহীন মানুষের আশ্রয়স্থল। স্কুলভবন নানা কারণেই নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তার ফলে বছরের নির্দিষ্ট শ্রেণির যে নির্দিষ্ট সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম, তা শেষ হবে কী করে? ছাত্রছাত্রীরা কতটা শিক্ষা নিয়ে পরের ক্লাসে যাবে? তাদের ক্ষতি কী করে পূরণ করা যাবে?
সরকার বদলালেও এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তগুলো বদলায়নি জানিয়ে জেলার এক প্রবীণ শিক্ষক দিলীপ কুমার দাস বলেন, “একই রীতি চলে আসছে বছরের পর বছর। এমনিতেই দীর্ঘ দিন লকডাউনের ফলে শিশু শিক্ষায় ব্যাপক ক্ষতি হল আমাদের জেলায়। অথচ প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব আরও বাড়া দরকার ছিল আমাদের মতো জেলায়।” বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক মোসাব্বর হোসেন বলেন, “সাধারণ গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের ছেলেমেয়েরাই মুলত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে আসে। এক সময় প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়া হয়েছিল। সেই পাশ-ফেল এখনও চালু তো হলই না, উল্টে এই আমলে বিদ্যালয় ছুটির সংখ্যা বেড়েছে নানা ভাবে।” নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক নব্যেন্দু সরকার বলেন, “যাঁরা এখন নিভৃতবাসে থাকবেন, তাঁরা চলে গেলে বিদ্যালয় ভবনগুলো জীবাণুমুক্ত না করে বিদ্যালয় খোলা যাবে না।” ফলে বিদ্যালয়ের দরজা খোলা এখনও অনেক দেরি আছে বলে মত তাঁদের।
পাশাপাশি অভিভাবকদের অভিযোগ পড়ুয়াদের প্রতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দরদ ও দায়িত্বের অভাবে ছাত্রদের বিদ্যালয়মুখী হতে দেন না তাঁরা। বহরমপুরের বাসিন্দা জোৎস্না সমাজদার বলেন, “অনেক সময় ক্লাসে শিক্ষকরা থাকেন না বললেই চলে।”
অথচ একটা সময় ইংরাজি মাধ্যমের রমরমার মধ্যেও পড়াশোনার মান উন্নত থাকায় বহরমপুরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিজের ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন বহরমপুরের বাসিন্দা কবিতা সরকার। তিনি বলছেন, “প্রধানশিক্ষক সহ অন্য শিক্ষকরা দরদ দিয়ে পড়াতেন বলেই সেই সময় ওই বিদ্যালয় থেকে পাশ করা পড়ুয়াদের পরেও ভাল রেজাল্ট করতে দেখেছি।”
মুর্শিদাবাদ জেলার ৪১টি চক্রের মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩১৮২টি। সরকারি আর্থিক সহায়তায় এদের অনেকের বিদ্যালয় পরিকাঠামোই গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘ লকডাউনের সময় রাজ্য শিক্ষা দফতর মডেল প্রশ্নোত্তর তৈরি করে বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সেই নির্দেশ মেনে অনেকেই লকডাউনে হোয়াট্সঅ্যাপে নিজেদের মতো করে পড়াশোনা করাচ্ছেন। তবে শতাংশের বিচারে, তা অত্যন্ত কম বলছেন শিক্ষকদেরই একাংশ। নবগ্রাম চক্রের প্রাথমিক বিদ্যালয়, নগড়া নীরোদাদেবী আদিবাসী নিম্নবুনিয়াদি বিদ্যালয় ২০০০ সালের বন্যার সময় ত্রাণ শিবির হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ত্রাণ শিবিরের জন্যই তড়িঘড়ি নির্মিত হয়েছিল অতিরিক্ত একটি বিদ্যালয় ভবন। কিন্তু বিশ বছর পেরিয়ে গেলেও সেখানে রঙের আঁচড় তো দূর, প্লাস্টারই হয়নি বল জানাচ্ছেন প্রধানশিক্ষক রথীন্দ্রনাথ সরকার।
করোনার জন্য বিদ্যালয় ভবন নেওয়ার কথা ভেবেছেন সরকারি আধিকারিকরা। রথীন্দ্রনাথ বলছেন, “বহু বার বিদ্যালয় ভবন সংস্কারের দাবি জানিয়ে সরকারি দফতরে দফতরে ঘুরেছি। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি।” রথীনবাবুর দাবি, “পিছিয়ে পড়া নবগ্রামের নগড়া মানুষের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় লকডাউনের সময় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারিনি বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের জন্য।” জলঙ্গি ব্লকের সংখালঘু অধ্যুষিত ফরিদপুর অঞ্চলের টিকোরবাড়িয়ায় একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪৩ নম্বর টিকোরবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রায় চার দশকের এই বিদ্যালয়ের বর্তমান পড়ুয়ার সংখ্যা ১৯৩ জন। এই বছর এই বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। টিকোরবাড়িয়া এলাকার মানুষজনের প্রধান জীবিকা চাষবাস। সময়ের সঙ্গে তাল ঠুকে ভিন্ রাজ্যেও কাজের জন্যও যান ওই এলাকার মানুষজন। তাঁদের ছেলেমেয়েদের হাতেখড়ি হয় এই বিদ্যালয়ে, তা জানিয়ে প্রধান শিক্ষক অম্বুজাক্ষ মণ্ডল বলছেন, “গ্রামের মধ্যে একমাত্র উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় টিকোরবাড়িয়া কাজি নজরুল উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এখানকার ছেলেমেয়েরা। তাদের পড়াশোনার আগ্রহও যথেষ্ট।” লকডাউনের সময় সরকারের দেওয়া কাজগুলো মিড ডে মিলের চাল আলু বিতরণের সময় অভিভাবকদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বেশিরভাগ পড়ুয়ার বাড়িতে স্মার্টফোন নেই বলে জানান ওই শিক্ষক। স্কুলছুট কমাতে পড়াশোনায় উৎসাহ দিতে নানা সময় নানা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। খেটে খাওয়া মানুষদের সন্তান যাতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে তার জন্য চালু হয়েছিল মিড ডে মিল। জেলার শিক্ষাবিদরা বলছেন, “সব হয়েছে কিন্তু আসল কাজ শিক্ষার প্রসার ঘটানো সেটাই হয়নি।”
পড়াশোনায় মুর্শিদাবাদ চক্রের কুতুবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০০৮ সালে আর্দশ বিদ্যালয়ের পুরস্কার পায় ওই চক্রের মধ্যে। এই বিদ্যালয় জেলা সর্বশিক্ষা মিশনের বিচারে মুর্শিদাবাদ চক্রের মধ্যে ‘নির্মল বিদ্যালয়’ পুরস্কার পায় ২০১৫ সালে। ২০১৭ সালে রাজ্য সরকার জেলার সেরা বিদ্যালয় হিসাবে কুতুবপুর ‘শিশুমিত্র বিদ্যালয়’ পুরস্কার দেয়। কুতুবপুর, বাঁশগোলা, পলন্দরবাগ প্রভৃতি এলাকার নিম্নবিত্ত ঘরের পড়ুয়ারাই এখানে পড়তে আসেন। সেই বিদ্যালয় লকডাউনের সময় পড়ুয়াদের জন্য হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ খুলে বিভাগ অনু্যায়ী প্রত্যেক শ্রেণির প্রতিদিন পড়াশোনা হলেও মোট পড়ুয়ার মাত্র পঞ্চাশ শতাংশ পড়ুয়া সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করছে বলে জানান প্রধান শিক্ষক মাহামুদাল হাসান। লকডাউনের মাঝে ঘূর্ণিঝড়ে ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যাহত হয়েছে। বন্ধ হয়ে যায় অনলাইন ক্লাসও।