Coronavirus in West Bengal

এই পথে লোকাল ট্রেন চলুক

রাজ্যের প্রশাসনের পক্ষে লোকাল ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া যে সহজ কাজ নয়, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিলক্ষণ জানেন— এক কালে কেন্দ্রের রেলমন্ত্রকের দায়িত্ব তো নিজহাতেই সামলেছেন।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০০
Share:

—ফাইল চিত্র।

সরকারি পরিবহণ সংস্থার বাস তো অনেক দিন আগেই রাস্তায় নেমেছিল, এ বার মেট্রোও চলতে শুরু করল। দূরে বা দেশান্তরে যেতে কিছু স্পেশাল ট্রেন বা প্লেনও এখন মিলছে; কিন্তু, জেলাশহরগুলোতে গত ছ’মাস ধরে অটো, টোটো আর ভাড়ার গাড়িই ভরসা— শহরতলির রক্তধমনী হিসেবে পরিচিত লোকাল ট্রেনের এখনও দেখা নাই রে।

Advertisement

সবার আকুতি মেনে তবে কি লোকাল ট্রেন চলতে পারে এখন? রাজ্যের প্রশাসনের পক্ষে লোকাল ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া যে সহজ কাজ নয়, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিলক্ষণ জানেন— এক কালে কেন্দ্রের রেলমন্ত্রকের দায়িত্ব তো নিজহাতেই সামলেছেন। মেট্রো-রেল কেন্দ্রের আওতায় হলেও, কলকাতায় মেট্রো-কর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে মেট্রো চালু করে দেওয়া যায়, এমনকি পরীক্ষার দিনে আগাম বন্দোবস্তও সম্ভব। কিন্তু, পূর্ব বা দক্ষিণ-পূর্ব রেলের গঙ্গার ধারের সদর দফতরগুলোতে, প্রতিবেশী হলেও, নবান্ন-র প্রতিপত্তি সামান্যই। ট্রেন চলবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের।

গত কয়েক মাসে লোকাল ট্রেন যে একেবারেই চলেনি, তা নয়; জরুরি পরিষেবা হিসেবে কিছু ট্রেন চালু ছিল বা আছে— যেমন, সারা দিনে তিনটে লোকাল ট্রেন হাওড়া থেকে বর্ধমান যাতায়াত করে। তাতে একটা ঘটনা ঘটছে— হাওড়ায় পর্যাপ্ত রক্ষী-পাহারাদার থাকলেও, মাঝের স্টেশনগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রায় নেই। বালি থেকে বর্ধমান, অথবা মানকুণ্ডু থেকে রিষড়া, বিনা বাধায় চলে যাওয়া যায়।

Advertisement

করোনার প্রেক্ষিতে পুরোমাত্রায় লোকাল ট্রেন চালানোর পক্ষে-বিপক্ষে দু’দিকেই যুক্তি আছে। প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক সমস্যাকে অগ্রাহ্য করে লোকাল ট্রেন চালানোর ‘কস্ট-বেনিফিট’ হিসেব করা যেতে পারে। তবে, হিসেবটা কষার আগে দুটো কথা মনে রাখা ভাল। প্রথমত, লোকাল কথাটার মানে কী? এ ক্ষেত্রে শুধু কলকাতার সঙ্গে প্রান্তের সংযোগ রক্ষাকারী লোকাল ট্রেনের কথা ভাবলে চলবে না; কলকাতা থেকে দূরের জেলার লোকালয়েরও নিজস্ব ‘লোকাল’ এলাকা আছে বইকি! দুই, ভাল না খারাপ, সেই বিচারের মানদণ্ডটিকে স্থান এবং ব্যক্তি-নিরপেক্ষ হতে হবে; অর্থাৎ, কলকাতার বাসিন্দা বা যাত্রী বলেই সেই দলটি বেশি গুরুত্বের, অতএব তাঁদের সমাজে সুবিধে বেশি হবে বলে পড়িমরি করে মেট্রো চালাতে শুরু করব, আর অন্য দিকে পুরুলিয়া থেকে বাঁকুড়ার মধ্যের যাত্রীদের দ্বিতীয় শ্রেণি হিসেবে গণ্য করব, সেটা কাম্য নয়— অঙ্কের চোখে সবাই সমান।

বাস-ট্রেন চললে করোনা-সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে তো বটেই; বাস বা মেট্রোর তুলনায় ট্রেনের ক্ষেত্রে যাত্রিসংখ্যা অনেক বেশি, অতএব আশঙ্কাও বেশি। শহরতলির স্টেশনগুলো তো মেট্রোর মতো ঘেরা নয়, ট্রেনের দরজাও বন্ধ হয় না— কাজেই, লোকাল ট্রেনের বিপক্ষে প্রথম ও প্রধান যুক্তি হল, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে আবশ্যক যাত্রী নিয়ন্ত্রণ বা ভিড় সামাল দেওয়া প্রায় অসম্ভব। মেট্রোর পক্ষে যে ভাবে নানাবিধ আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করে যাত্রার সময় বেঁধে যাত্রিসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, সেটা লোকাল ট্রেনের ক্ষেত্রে ব্যবহার্য নয়; হয়তো, মেট্রোয় যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, লোকাল ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রীর কথা মাথায় রাখলে এই ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্যও নয়।

আবার অন্য দিকে, এই উন্মুক্ত পরিবেশটাই, বাস বা মেট্রোর তুলনায়, ট্রেন চালানোর পক্ষে সহায়ক। বড় স্টেশন এবং লোকাল ট্রেনের খোলা কামরা তো মন্দের ভাল— বাস বা মেট্রো কিন্তু বদ্ধ, তাই সংক্রমণের আশঙ্কাও সেখানে বেশি। বিদেশের বড় শহরের পরিবহণের কাঠামোর অনুসরণে কাজে লাগানো যেতে পারে আমাদের লোকাল ট্রেন-নেটওয়ার্কের গঠন এবং জংশন স্টেশনগুলোকে।

তা হলে, সমাধান হল, বর্তমান নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে, মহানগরে না ঢুকেই আমরা ছোট ছোট শাখায় শাট্‌ল ট্রেন চালাতে পারি। তবে, এগুলোর কোনওটাই হাওড়া বা শিয়ালদহগামী হবে না, যেমন, খড়্গপুর-মেচেদা, ব্যান্ডেল-নৈহাটি, শেওড়াফুলি-তারকেশ্বর ইত্যাদি শাখা। সেখানেই শেষ নয়, এই সব শাখার ট্রেনের সঙ্গে অন্য পরিবহণ— লঞ্চ, মেট্রো, বাস ইত্যাদিও জুড়ে দেওয়া যায়। মেমারি থেকে শেওড়াফুলি এসে নদী পার হয়ে ব্যারাকপুর যাওয়া যাবে সহজেই। কলকাতাগামী যাত্রীদের তত কিছু এসে না গেলেও অন্তত কিছু যাত্রীর তো এতে সুবিধা হওয়ার কথা। বেশির ভাগ ক্রিয়াকর্ম কলকাতায় হলেও অন্যান্য শহরেও কিছু কাজ-কারবার চলে নিশ্চয়ই।

রেলপথের এক এক শাখার এক এক করোনা-চিত্র হতেই পারে, সেই অনুযায়ী লোকাল জ়োন ভাগ করে, প্রয়োজনমাফিক লোকাল লকডাউন বা লোকাল আনলক করা সম্ভব। এতে কাঙ্ক্ষিত বিকেন্দ্রীকরণও হল, আবার ধাপে ধাপে সিদ্ধান্ত নিয়ে ধীরে ধীরে আনলক করাও গেল। অদূর ভবিষ্যতে বিপত্তি কাটলেই এই সব শাখা-পরিষেবাগুলিকে শিয়ালদহ বা হাওড়া অবধি বাড়ানোও সহজ হবে।

একই পদ্ধতিতে দূরের জেলা, উত্তরবঙ্গ বা পুরুলিয়াতেও, ‘লোকাল’ ট্রেন চালানো যেতে পারে। যেমন, পুরুলিয়া থেকে বাঁকুড়া, বা আদ্রা থেকে আসানসোল, এই সব বিচ্ছিন্ন শাখাগুলোতে ট্রেন চললে তার করোনা-প্রভাব অন্যত্র হয়তো পড়বে না। এ ভাবে কাঁচামাল, আনাজ, ছানা ইত্যাদির পরিবহণ বা ভেন্ডারও আলাদা আলাদা ভাবে করা সম্ভব হবে। ইংল্যান্ডের মতো দেশে এ ভাবেই লকডাউনে ‘সাপ্লাই-চেন’ চালু ছিল।

করোনা এক িদন চলে গেলেও এই নেটওয়ার্ক মডেলটা আমাদের কাছে পাকাপাকি ভাবে থাকতে পারে। ভবিষ্যতের ‘নিউ নর্মাল’-এ এহেন বিকেন্দ্রীকরণ মহানগরের ও গোটা রাজ্যের পরিবহণে উন্নতি ঘটাতে পারে। করোনা আমাদের কয়েকটা সুযোগ এনে দিয়েছে— আমূল বদল করে দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হওয়ার সুযোগ।

অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement