গাজিয়াবাদে চলছে বাসের প্রতীক্ষা। ছবি: পিটিআই।
এতদিন যে ভয়টা পাচ্ছিলাম, সেটাই কি তবে সত্যি হতে চলেছে? বাকিদের মতো আমার বাড়ির টিভিতেওএকটার পর একটা খবরের চ্যানেল চলছে। এরই মাঝে হঠাৎ ভেসে উঠল একটা মৃত্যুর খবর। একজন মানুষ মধ্যপ্রদেশে বিপদের সময়ে তাঁর পরিজনের কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, আমরা তো অন্তরীণ। অগত্যা কর্মক্ষেত্র থেকে আগরাহাইওয়ে ধরে ২০০ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছেছিলেন। আর ১২৪ কিমি দূরেই ছিলেন পরিজনেরা। কিন্তু, পারেননি।
উত্তরপ্রদেশ-দিল্লির সীমান্তে মানুষের তাল। কাতারে কাতারে মানুষ ওই মৃত ব্যক্তিটির মতোই পরিজনের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন। কিন্তু, তাঁদের আর যাওয়ার জায়গা নেই। সরকার আটকে দিয়েছেন তাঁদের। সরকারের দাবি, এঁদের মধ্যে একজনও যদি কোভিডের বাহন হয়ে থাকেন তাহলে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে যে ভাবে তাঁদের সীমান্তে আটকে দেওয়া তাতেই তো কয়েক হাজার মানুষ রাতারাতি কোভিডের শিকার হয়ে যেতে পারেন!
এই প্রসঙ্গেই বিজেপি-র ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, প্রাক্তন ব্যবসা পরিচালক ও প্রসার ভারতীর পরিচালন পর্ষদের সদস্য সুনীল আলাঘ বললেন, দোষটা নাকি রাজ্য সরকারের! একটি টেলিভিশন চ্যানেলের বিতর্কে অংশ নিয়ে তাঁর দাবি, ক) এঁদের বাড়ি ফিরতে দেওয়া চলবে না, খ) সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকেই ভাবতে হবে কী ভাবে এই সমস্যা সামলাতে হবে।
আরও পড়ুন: জীবিকা হারিয়ে পথে, ভবিষ্যৎও সম্পূর্ণ অনিশ্চিত
সঙ্গে সঙ্গেই শিরদাঁড়া কেমন শিরশির করে উঠল। যেমনটি সন্দেহ করা গিয়েছিল, তেমনটিই সত্যি? সরকারের আসলে কোনও পরিকল্পনা কি সত্যিই নেই! ব্যর্থতার প্রাথমিক প্রকাশেই শুরু হবে আমরা-ওরার লড়াই? লকডাউন ঘোষণার দিন প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম সামাজিক অন্তরীণ ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল এই ব্যবস্থা কেন আগেই নেওয়া হয়নি তা নিয়ে।এবং তিনি জানতে চেয়েছিলেন শহর থেকে ইতিমধ্যেই যাঁরা গ্রামে ফিরে গিয়েছেন তাঁদের ছোঁয়ায় এই রোগের সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা নিয়ে। সরকার কিন্তু এর কোনও উত্তর দেননি। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বিরোধী মতকে খুব একটা আমল দেওয়ার জন্য পরিচিত নন। কিন্তু, এই জবাবটা সাধারণের কাছে খুবই জরুরি।এই যুদ্ধ জিততে গেলে করণীয় এবং পদক্ষেপের ব্যর্থতা নিয়ে স্বচ্ছ আলোচনার পরিসর তৈরি না হলে আমরা কিন্তু কিছুতেই করোনা-ব্যূহ থেকে বেরোতে পারব না।
করোনা-চক্রে জিততে গেলে নিশ্চয়ই দেখতে হবে যাতে এই রোগের সংক্রমণ না ছড়াতে পারে। তার জন্য যা করার করতে হবে। কিন্তু মানবিকতা? পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে এই আচরণের মূলে তো ভয় একটাই, সংক্রমণ ছড়াবে। এঁদের সবাইকে পরীক্ষা করে যাতেঘরে ফেরার ছাড়পত্র দেওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা নেই। তাই প্রত্যেককেই জীবাণুবাহী হিসাবে ধরে নিয়ে আটকে রাখ। কিন্তু কোথায়? এবং কী ভাবে?
নয়াদিল্লির আনন্দ বিহার বাস টার্মিনালে ঘরে ফেরার জন্য ভিড়। ছবি: পিটিআই।
আমাদের দেশে কিন্তু এই রোগের ছোবল পড়েছে বছরের গোড়াতেই। তখন কিন্তু আমরা মানতে চাইনি এর প্রকোপ। অথচ চিনের দুরাবস্থা দেখে, যদি আঘাত আসে, কী ভাবে তার মোকাবিলা করব তার পরিকল্পনা তখনই করা উচিত ছিল। তা তো করিইনি, উল্টে অভিঘাত এড়াতে খাঁচায় বন্দি করতে চাইছি না তো নাগরিককে?
তামিলনাড়ুতে যে বাড়িতে অসুখ ধরা পড়ছে, সে বাড়িতে স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেশজুড়ে যা চলছে, দুঃখের সঙ্গে মানতেই হচ্ছে, সেটা‘বেনহুর’-এ দেখা সেই কুষ্ঠরোগীদের ব্রাত্য করার মতোই। এবং খাঁচায় বন্দি করার উপমাটি চেষ্টা করেও এড়াতে পারছি না।
আমরা মেনেই নিয়েছি করোনার অভিঘাত অভূতপূর্ব। দেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের বিপরীতে হেঁটেই, বিজেপি সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। কিন্তু কোথাও গিয়ে মনে হচ্ছে, সমস্যা তীব্র হলেই সমস্যার সমাধান খুঁজতে হাত মেলানোর বদলে নেতারা ফিরে যাবেন পুরনো যুদ্ধেই।
ফেরা যাক মূল প্রসঙ্গে। একটা চট-জলদি করা অঙ্কে দেখা যাচ্ছে, আগামী এক মাসে কম করে হলেও দেশ হারাবে ৮.৭৬ লক্ষ কোটি টাকার নতুন উৎপাদন— পণ্য ও পরিষেবা মিলিয়ে। রোজগার হারিয়ে সব থেকে অসহায় হয়ে পড়বে কিন্তু সেই মানুষরাই, যাঁদের আমরা ঘরে ফিরতে দিচ্ছি না।
আরও পড়ুন: সুন্দরবনের কপালে কী রয়েছে
কী হবে সেই পরিজনদের, যাঁরা সম্পূর্ণভাবেই এঁদের রোজগারের অংশের উপর নির্ভরশীল? কী হবে তাঁদের, যাঁরা পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন ও প্রশাসনের গুঁতোয় সামাজিক ভাবে ব্রাত্য হয়ে আজ ফুটপাতবাসী?
গ্রামে ফেরা যাচ্ছে না, বাড়িওয়ালা থাকতে দিচ্ছেন না, কারখানার মালিক খেঁদিয়ে দিচ্ছেন, সরকার স্টিকার লাগাচ্ছে বাড়ির দরজায়— বকলমে অচ্ছুৎ বলে। আমরা জানি এই রোগের মোকাবিলা করার সামর্থ্য আমাদের এখনও সীমিত। আমরা এ-ও মেনে নিয়েছি যে, সামাজিক দূরত্ব ছাড়া এ দেশে এই রোগের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোখার অস্ত্র নেই আমাদের হাতে এখনও। কিন্তু, যা করতে পারি তা কি করছি?
আমাদের দেশে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ১২ কোটির উপরে। সরকারের দাবি, যা যা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা সবই পরিকল্পিত। তাই যদি হয়, তাহলে ১২ কোটি শ্রমিকের কথা সরকারের মাথায় ছিল না? সরকারি ইঙ্গিত, এটা রাজ্যের সমস্যা। কিন্তু পরিকল্পনা তো করছে কেন্দ্র। তাহলে? রাজ্যের সীমান্ত বন্ধের নির্দেশও তো এসেছে কেন্দ্রের কাছ থেকেই? তাহলে?
গরম পড়েছে। যুদ্ধকালীন পদক্ষেপে করোনার মোকাবিলার লড়াই করছে সবাই— সরকারি থেকে বেসরকারি ক্ষেত্র। যদিও এখনও লড়াইয়ের অস্ত্রের জোগানের অঙ্ক খুব একটা স্বচ্ছ নয়, তবুও একটা সাজ সাজ রব পরিমণ্ডলে তীব্র হচ্ছে। কিন্তু এই মানুষগুলোর কী হবে? কেন্দ্র ও প্রতিটি রাজ্য সরকারের যৌথ মানবিক উদ্যোগ ছাড়া কিন্তু আমাদের মহামারি দেখতে হতে পারে। আমরা কি ভাবছি?