মাস্কেই আটকে জীবন। রামপুরহাটে। ছবি: সব্যসাচী িসলাম
স্কুলপড়ুয়া জীবনে ‘আজ আমাদের ছুটি রে ভাই আজ আমাদের ছুটি’ গানটা গাইতে কী ভীষণ আনন্দ হতো। দিনরাত শুধু পড়া আর পড়া, তার উপর পরীক্ষা এসবের মধ্যে যেন মুক্তির বার্তা নিয়ে আসতো লম্বা ছুটি। ছুটি মানে অফুরন্ত সময়, দেরি করে ঘুম ভাঙা, খেলা আর বেড়াতে যাওয়া। কিন্তু সে ছুটি যখন এমন হয় যে ঘর হতে দুই পা ফেললেই বিপদ, তখন সে যে কেমন হতে পারে গত ক’দিনে শুধু এদেশ নয় গোটা দুনিয়া টের পাচ্ছে। ভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কায় ঘরে বন্দি থাকার সময় মানবজাতির ইতিহাসে শেষ কবে এসেছে বলা মুশকিল, অন্তত জীবিত মানুষেরা এমন দুনিয়াজোড়া দীর্ঘ সময়ব্যাপী ছুটি আগে কখনও পাননি। মনে হয় যেন গোটা পৃথিবীটা ঢুকে গেছে এক কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে, যেখানে সময় স্তব্ধ।
অনেকেই ভাবেন সরকারি কর্মচারীরা ছুটির কাঙাল, বছরের শুরু থেকে তারা ছুটির হিসাব করেন আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছুটি খুঁজে বেড়ান। অবশ্য পুলিশ প্রশাসন আর স্বাস্থ্যব্যবস্থাও সরকারি। তারা কিন্তু এই করোনার দিনেও একনিষ্ঠ সেবা করে চলেছেন। আর বাকিরা ? তারা কি পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা এই ছুটিতে তুমুল আনন্দে মেতে উঠেছেন? অবশ্য এই আনন্দে যোগ দেবেন তাঁরাই যাঁদের মাসমাইনের ব্যবস্থা নিশ্চিত, যাঁরা নিজের ঘরে পরিবারের সাথে দিনান্তে শাক ভাত না মাছ ভাত খেতে পারেন, পরের দিনের অন্নের সংস্থান নিয়ে তাঁদের ভাবতে হয় না।
এখন ছুটির কথা লিখতে গেলেই তাঁদের মুখ মনে পড়ে, যাঁরা শত শত মাইল হেঁটে চলেছেন গোটা পরিবার নিয়ে শুধু ঘরের টানে। এঁরা তাঁরাই যারা শহরগুলিকে খাইয়ে-পরিয়ে ধারণ করে রাখেন। আজ তাঁরা চলেছেন অন্য এক ছুটির ফাঁদে পড়ে। এই বিশাল পথে তৃষ্ণার জলটুকুও যাঁদের কাছে দুর্লভ। বিশ্বব্যাপী ‘উন্নয়ণ’ নামক সমুদ্র মন্থনের গরলটুকুই এঁরা বরাবর পেয়ে থাকেন, অমৃত অন্য কোথাও জমা হয়।
ছুটির গল্পটা এদের নয়। ছুটির কথা সেই সকলের যাঁরা প্রতিদিন সকালে উঠে নাকে মুখে গুঁজে দফতরের দিকে রওনা হন, বাড়ির মহিলারা তাঁদেরও আগে উঠে খাওয়ার ব্যবস্থা করেন, হাতের কাছে জুগিয়ে দেন টিফিনবাক্স। তাঁদের এই দিনযাপন, প্রাণধারণ হঠাৎ করে বেবাক থমকে গিয়ে সবাই এখন ঘরবন্দি।
ঘর মানে কী? এখনতো বর্গফুটের যুগ, সাতশো থেকে বারোশো এরই মধ্যে বেঁধে ফেলো নিজেকে লক্ষ্মণের গন্ডিতে। কীভাবে কাটছে দিনগুলো এমন লম্বা ছুটিতে যার জন্য হাপিত্যেশ করে থাকা হত। কিন্তু ছুটিতে আরো দূরে আরো উড়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই, ওড়ার তো আর কোনও প্রশ্নই ওঠে না কারণ এই ওড়াপথেই এই ভাইরাস ঢুকেছে এদেশে। মন্বন্তরে মরিনি আমরা তবে আজ মারীর ভয়ে ঘরে ঢুকতে হয়েছে আর খুঁজতে হচ্ছে সময় কাটানোর পদ্ধতি। ভাগ্যিস ইন্টারনেট রয়েছে। তাই যোগাযোগের ঠিকানা এখন সামাজিক মাধ্যম। জানা যাচ্ছে, যে সমস্ত সফটওয়্যার এর মাধ্যমে একই সাথে বহু মানুষ পরস্পরকে দেখে থেকে জুড়ে থাকতে পারে সে প্রযুক্তির চাহিদা এখন তুঙ্গে।
সামাজিক দূরত্ব বলে যে কথাটি বাজারে চলছিল সেটা আসলে হওয়া উচিত শারীরিক দূরত্ব, তাকে বজায় রেখে সামাজিক মেলামেশার সবচেয়ে বড় অঙ্গন এখন সোশ্যাল মিডিয়া। চূড়ান্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের প্রবক্তাও এই উঠোনে উঁকি দিয়ে প্রমাণ করছেন মানুষ মানুষকেই চায়। সেখানে কেউ নতুন রান্নার পদ শেখাচ্ছেন, কেউ খেলছেন নতুন খেলা, কেউ চ্যালেঞ্জ করছেন কম বয়সের ছবি পোস্ট করার, কেউবা ধাঁধা ছুঁড়ছেন পরস্পরকে। এই বসন্তের জ্যোৎস্না রাতে সবাই বনে না গিয়ে মোবাইলে চাঁদ দেখছেন।
ছুটি কাটানোর প্রথাগত উপায় এখন কাজে আসছে না। নেই পাহাড় সমুদ্রে যাওয়া, নেই হোম ডেলিভারি। অতএব আনাড়ীরা ভিডিওতে আলুপোস্ত রান্না দেখে ঘরে রাঁধছেন আর ছবি দিচ্ছেন। মানুষের জীবনে রান্নাঘরের যে কত বড় ভূমিকা গৃহিণীদের পাশাপাশি কর্তারাও টের পাচ্ছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা ঘটছে তা হল ঘর বন্দি অবস্থায় সন্তানদের সাথে নতুন করে বোঝাপড়া। এমন অনেকেই আছেন দিনান্তে সন্তানের ঘুমন্ত মুখ ছাড়া আর কিছু দেখার সুযোগ পান না, এখন তারা জমিয়ে বাচ্চাকে গল্প শোনাচ্ছেন। স্কুল আর টিউশন নিয়ে জেরবার বাচ্চারা দেখছে মা-বাবা মন্দ পড়ান না। আর মা-বাবারা তাঁদের মা-বাবাদের খোঁজ নিচ্ছেন। বৃদ্ধাশ্রমেরএক কোণে একটি ফোনের জন্য দিনের পর দিন প্রতীক্ষায় থাকা মায়ের জন্য আজ সময় আছে । অন্তত ভিডিও কলেও নাতি নাতনির সাথে কথা বলানো যায়। সময় নেই এই অজুহাত এখন চলবে না। রান্নার উপকরণ যখন সুলভ নয় তখন দিদিমার কাছেই জানা যেতে পারে হাতের কাছে যা আছে তা দিয়ে কী রান্না হয়। একেই বলে কোয়ালিটি টাইম। যাঁরা দিবারাত্র অফিসের কম্পিউটারে চোখ রেখে ক্লান্ত তাঁরা এখন বিয়েতে পাওয়া শরৎ রচনাবলী উল্টে দেখছেন, তানপুরা নিয়ে বসে পড়ছেন কেউ কেউ। লকডাউন উঠতে উঠতে অনেক নবীন লেখক ও শিল্পীর সৃষ্টি আমরা দেখতে পাবো।
পৃথিবীর এই জিরিয়ে নেওয়ার দিনে উর্দ্ধশ্বাসে লক্ষ্যভেদের দিকে দৌড়ে যাওয়া আমাদের মনগুলো একটু দম নিয়ে ভাবতে পারে। হাতে সময় পেয়ে শুধু পুরানো ছবি খুঁজে আনলে হবে না, ভাবতে হবে এর পরের কথা। এই অনিশ্চিত পর্ব শেষে পৃথিবীটা একই রকম থাকবে না। কেন না ভাইরাস বার্তা দিয়েছে আজকের এই দুনিয়ায় আমরা কেউ বিচ্ছিন্ন নই। দুনিয়াজুড়ে রাষ্ট্রনেতারা যখন কল্পিত শত্রু তৈরি করে গোষ্ঠীতন্ত্র আর বিচ্ছিন্নতাবাদের পাঠ দিয়ে মানুষে মানুষে দেওয়াল তুলতে চাইছেন, উন্নয়ণের নামে জল-স্থল-বাতাস এমনকি ভূগর্ভও তোলপাড় করছেন, তখনই কোভিড-১৯ জানান দিল, আমাদের সীমানা, আমাদের কাঁটাতার, আমাদের রক্ষীদল সবকিছু টপকে চলে আসতে পারে মারণ রোগ যার মোকাবিলায় পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পন্ন দেশকেও নাস্তানাবুদ হতে হল। হাতের মুঠোয় যাদের বিশ্ব তাদের আজ লেডি ম্যাকবেথের মতো বারবার হাত ধুতে হচ্ছে।
এ ছুটি শুধু উপভোগের নয়, বরং গভীরে ভাবার সময়। গত শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমাদের শ্রেষ্ঠ চিন্তক কবি তাঁর অতি প্রিয়জন ‘ভাই ছুটি’কে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের জীবন সহজ এবং সরল হোক, আমাদের সংসার যাত্রা আড়ম্বর-শূন্য এবং কল্যাণ পূর্ণ হোক।’’ এই অতিমারীর দিনে ঘরে বসেও যেন সেই কল্যাণকেই আবাহন করা যায়।
লেখক স্কুল শিক্ষিকা, মতামত নিজস্ব