ফাইল চিত্র।
এক বিপদ আসিয়া অন্য বিপদের কথাটি কিছু কালের জন্য ভুলাইয়া দেয় ঠিকই, কিন্তু বিপদ তাহাতে কমে না। বরং ক্ষেত্রবিশেষে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে থাকে। শহরের জলসঙ্কটের কথাই ধরা যাউক। গত গ্রীষ্মেও কলিকাতার জলস্তর যে বিপুল ভাবে হ্রাস পাইতেছে, তাহা লইয়া জোর চর্চা চলিতেছিল। দক্ষিণ ভারতের নির্জলা শহরগুলির কঠিন পরিস্থিতির উদাহরণ টানিয়া বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়াছিলেন, কলিকাতাও সেই পথেই চলিতেছে। একদা সুজলা শহরটি ভিতর হইতে ক্রমশ শুকাইতেছে। অবিলম্বে অপচয় বন্ধ না হইলে এবং দৈনন্দিন ব্যবহারে রাশ না টানিলে বিপর্যয় ঘটিবে। এক বৎসর অতিক্রান্ত। অতিমারি-আক্রান্ত মহানগরে এখন বিপরীত চিত্র। সংক্রমণ রোধ করিতে বারংবার হাত ধুইবার, পোশাক কাচিবার, এবং সংক্রমণ ছড়াইবার সম্ভাব্য স্থানগুলিকে শুদ্ধকরণের পরামর্শ দেওয়া হইতেছে। অর্থাৎ জলের ব্যবহার পূর্বের তুলনায় ঢের বৃদ্ধি পাইয়াছে। এবং অপচয়ও বাড়িতেছে জলসঙ্কটের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুলিয়াই।
ভয় এইখানেই। পৃথিবীতে মোট জলের ৯৭ শতাংশই লবণাক্ত। মাত্র তিন শতাংশ জল ব্যবহারযোগ্য। ইহার মধ্যেও দুই-তৃতীয়াংশের কিছু অধিক কঠিন বরফ আকারে হিমবাহ এবং মেরুপ্রদেশে জমিয়া আছে। সুতরাং, অপচয়ের সুযোগ নাই। অথচ কার্যক্ষেত্রে তাহাই হইতেছে। ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি বার সাবান দিয়া হাত ধুইতে এক জনের ৩০-৪০ সেকেন্ড সময় লাগে। সেই সময় বদভ্যাসবশত কলটি খুলিয়া রাখিলে অন্তত চার লিটার জল খরচ হয়। এই হিসাবে একটি পাঁচ সদস্যের পরিবারে শুধুমাত্র হাত ধুইতে প্রতি দিন অন্তত ১০০-২০০ লিটার জল খরচ হইবার কথা। অথচ, সাবান ঘষিবার সময় কলটি কিছু ক্ষণ বন্ধ রাখিলেই এই খরচের পরিমাণ অর্ধেকে নামাইয়া আনা সম্ভব। দুর্ভাগ্য, এই সামান্য সচেতনতাটুকুও অধিকাংশ নাগরিকের নাই, প্রশাসনেরও নাই বলিলেই চলে। পুরসভার কলের জলে রাস্তা ভাসিতেছে, এমন দৃশ্য এখনও এই শহরে বিরল নহে।
জল অপচয়ের নিরিখে কলিকাতা দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে। পরিসংখ্যান বলিতেছে, প্রতি দিন শহরে যত পরিমাণ জল সরবরাহ করা হইয়া থাকে, তাহার চল্লিশ শতাংশই অপব্যয় হয়। অথচ, এই অপব্যয় রুখিবার কোনও সদর্থক প্রচেষ্টা প্রশাসনিক তরফে এখনও দেখা যায় নাই। গ্রীষ্মে জলসঙ্কট তীব্র হইলে নানাবিধ পরিকল্পনার কথা শুনা যায়। কিন্তু তাহার কয়টি বাস্তবায়িত হয়? জলকর, মাথাপিছু জল ব্যবহারের পরিমাণ বাঁধিয়া দেওয়া-সহ কড়া পদক্ষেপগুলি যথাযথ ভাবে করা হয় না মূলত রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং জনমোহিনী রাজনীতির মুখ চাহিয়া। অনিয়ন্ত্রিত জল খরচ চলিতে থাকে, অবাধে নামিতে থাকে ভূগর্ভস্থ জলস্তর। বেআইনি ভাবে শহর ও তাহার পার্শ্ববর্তী জলাশয়গুলি ক্রমাগত ভরাট করিবার কারণে প্রাকৃতিক ভাবে সেই ক্ষতি পূরণ হইবে, তেমন সম্ভাবনাও নাই। অতিমারির কারণে ইতিমধ্যেই শহরে জলের খরচ দ্বিগুণ হইয়াছে। দীর্ঘ লকডাউনের ফলে কলকারখানার কাজ সম্পূর্ণ গতি পায় নাই বলিয়া এই ক্ষতি হয়তো বুঝা যাইতেছে না। কিন্তু সঙ্কট কমে নাই। জলের ব্যবহার লইয়া এখনও প্রশাসন নড়িয়া না বসিলে বিপর্যয় অনিবার্য।