আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের মুখ্য অর্থনীতিবিদ গীতা গোপীনাথ বলিয়াছেন, অর্থনীতির হাঁড়ির হাল ঢাকিতে নাগরিকত্ব লইয়া হল্লা বাধাইয়া দেওয়া ভাল কৌশল— কিন্তু তাহাতেও বেশি দিন বিপদ লুকানো সম্ভব হইবে না। ভারতীয় অর্থনীতি গভীরতর গাড্ডায় পড়িতেছে। নরেন্দ্র মোদী আবার দার্শনিক প্রজ্ঞায় বলিয়া আসিয়াছেন, অর্থনীতি ফের ঘুরিয়া দাঁড়াইবে। কী করিয়া, তিনি বলেন নাই। অর্থাৎ, অদৃষ্টের ভরসায় আছেন। এক দিকে বিপদসঙ্কেত আর অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রীর নিয়তি-নির্ভরতা— দুই ঘটনা ঘটিতেছে একটি শব্দের প্রেক্ষাপটে। স্ট্যাগফ্লেশন। অর্থনীতি যখন একই সঙ্গে স্ট্যাগনেশন বা শ্লথ বৃদ্ধির হার এবং ইনফ্লেশন বা প্রবল মূল্যস্ফীতির শিকার হয়, সেই অবস্থাটির নামই স্ট্যাগফ্লেশন। নির্মলা সীতারামনকে প্রশ্ন করা হইয়াছিল, ভারতে কি স্ট্যাগফ্লেশন চলিতেছে? তাঁহারা অস্বস্তিকর প্রশ্নের জবাব দেন না। এই ক্ষেত্রেও দেন নাই। আর্থিক বৃদ্ধির হার এবং মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান অবশ্য অর্থমন্ত্রীর উত্তরের তোয়াক্কা করে নাই। জানাইয়াছে, ঘোর বিপদ। প্রতি কোয়ার্টার বা ত্রৈমাসিকে, অর্থাৎ তিন মাস অন্তর আর্থিক বৃদ্ধির হার ঘোষিত হয়। গত ছয়টি ত্রৈমাসিকে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার কেবলই কমিয়াছে। গত জুলাই হইতে সেপ্টেম্বরের ত্রৈমাসিকে তাহা দাঁড়াইয়াছে সাড়ে চার শতাংশে। তাহাও, অর্থশাস্ত্রীদের একাংশের মতে, হিসাবের কারিগরির কল্যাণে— নচেৎ হারটি আরও এক হইতে দেড় শতাংশ-বিন্দু কম হইত। গোটা অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশের বেশি হইবে, সেই সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। অন্য দিকে, গত নভেম্বরের তুলনায় এই নভেম্বরে খাদ্যপণ্যের খুচরা মূল্যস্তরের বৃদ্ধির পরিমাণ দশ শতাংশের সীমা অতিক্রম করিয়াছে। সামগ্রিক ভাবে খুচরা মূল্যস্তরের বৃদ্ধির পরিমাণ সাড়ে পাঁচ শতাংশের বেশি। গত তিন বৎসরে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ, ভারত সেই মহাসন্ধিক্ষণে উপস্থিত, যেখানে আসিতে কাটে আর্থিক বৃদ্ধির গতিভঙ্গ, যাইতে কাটে তুমুল মূল্যস্ফীতি। বিপদ আর কাহাকে বলে?
প্রশ্ন হইল, এই পরিস্থিতিটি কি সাময়িক, না ভারতীয় অর্থনীতিতে বেশ কিছু দিন স্ট্যাগফ্লেশনের দাপট চলিবে? গীতা গোপীনাথের কথা শুনিলে ভরসা হয় না ঠিকই, কিন্তু কেহ বলিতেই পারেন, এই মূল্যস্ফীতি সাময়িক। অপ্রত্যাশিত বর্ষার কারণে বেশ কিছু কৃষিপণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে, এবং তাহার ফলে কৃষিপণ্যের মূল্যস্ফীতি হইয়াছে। যে হেতু খুচরা মূল্যসূচকে কৃষিপণ্যের গুরুত্ব বিপুল, অতএব সেই কারণেই এই সূচকটিও বিপজ্জনক ভাবে বাড়িয়াছে। কৃষিপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আসিলেই পরিস্থিতি শুধরাইবে। যুক্তিটি ভুল নহে, কিন্তু সীমিত। অর্থশাস্ত্রের পণ্ডিতদের নিকট অর্থনীতির জ্বর মাপিবার বহুবিধ সূচক আছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ একটিমাত্র থার্মোমিটারে তাপমাত্রা মাপে। তাহা মূল্যস্ফীতি। বিশেষত খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি, কারণ সাধারণ মানুষের গায়ে তাহার আঁচই সর্বাপেক্ষা বেশি লাগে। এই মূল্যস্ফীতি মানুষকে ভীত করিবেই। ফলে, অত্যাবশ্যক পণ্য ব্যতীত সব ক্ষেত্রেই ভোগব্যয় কমিবে, সেই আশঙ্কা প্রবল। এত দিনে স্পষ্ট, অর্থনৈতিক মন্দার যে পরিস্থিতি ভারতে তৈরি হইয়াছে, তাহা মূলত চাহিদার অভাবের কারণেই। মানুষ ভোগব্যয় সঙ্কোচনের পথে হাঁটিলে চাহিদা আরও কমিবে। তাহার ফলে মন্দা পরিস্থিতিটি ভয়াবহতর হইবে, এবং আনুষঙ্গিক বিপদের তীব্রতাও বাড়িবে। মূল্যস্ফীতির হার যদি তলানিতেও নামিয়া আসে, অর্থব্যবস্থার লাভ হইবে না। সময়ে সচেতন হইলে এই বিপদটি অন্তত ঠেকানো যাইত। কৃষিপণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করিবার কাজটি সরকারের পক্ষে অসম্ভব ছিল না। কিন্তু, তাহার জন্য প্রথমে বিপদের সম্ভাবনা, এবং তাহার পিছনে নিজেদের দায় স্বীকার করিতে হয়। নাগপুরের পাঠশালার পড়ুয়ারা নিজেদের ভুল স্বীকার করিতে শিখেন নাই।