দাবানলের গ্রাসে। —ফাইল চিত্র
বিগত সেপ্টেম্বর হইতেই দাবানলে পুড়িতেছে অস্ট্রেলিয়া। ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের নিরিখে এই দেশে দাবানল অনিয়মিত ঘটনা নহে। কিন্তু দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে সাম্প্রতিক দাবানল বিধ্বংসী হইয়া উঠিয়াছে। বনাঞ্চল পুড়িয়া খাক, প্রাণ হারাইয়াছে একশত কোটি প্রাণী। আন্তর্জালে ছড়াইয়া পড়িয়াছে করুণ ভিডিয়ো, পথপার্শ্বে দাঁড়ানো অবস্থাতেই পুড়িয়া মরিয়া আছে ক্যাঙারু, উদ্ধারকারী মানুষের পা জড়াইয়া ধরিতেছে তৃষ্ণার্ত কোয়ালা। দাবানলে প্রাণ হারাইয়াছেন অনেক মানুষ, গৃহহীন অগণিত। এমনও হইয়াছে, আগুন লাগিয়া শহরের প্রবেশপথ রুদ্ধ হওয়ায় সহস্র মানুষ ছুটিয়া গিয়া দাঁড়াইয়াছেন সমুদ্রতটে, সেইখান হইতে হেলিকপ্টার বা জলযানে উদ্ধারকাজ সম্ভব হইবে বলিয়া। প্রাণহানি, অরণ্য ও বন্যপ্রাণের বিনষ্টি, বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়, সব মিলিয়া কার্যত বিভীষিকা হইয়া দাঁড়াইয়াছে এই দুর্যোগ।
এই দহনকাণ্ড চলিবে, বিস্তৃততর জায়গা জুড়িয়া ফিরিয়াও আসিবে, এমন শঙ্কা জাগিতেছে। দাবানলের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা আঙুল তুলিতেছে জলবায়ু পরিবর্তনের দিকেও। জলবায়ু পরিবর্তন এই দুর্যোগের একমাত্র না হইলেও অন্যতম এবং অনস্বীকার্য কারণ, বলিতেছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। অস্ট্রেলিয়ায় এই গ্রীষ্মে তাপমাত্রা পূর্বের সমস্ত রেকর্ড ছাড়াইয়া গিয়াছে। শুধু একটি বৎসরেই মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা, ঘটনা এমন হইলে ভাবনা কিছু কমিত। কিন্তু এই শুষ্ক আবহাওয়া চলিয়াছে দীর্ঘ সময় ধরিয়া, তাহার সহিত যোগ হইয়াছে আশাতীত ভাবে কম বৃষ্টিপাত। দাবদাহ, খরা, অনাবৃষ্টির প্রভাবে মাটি ও উদ্ভিদ শুকাইয়া হইয়া উঠিয়াছে দাবানলের প্রাকৃতিক ইন্ধন। দাবানল মূলত প্রাকৃতিক কারণে, কিছু ক্ষেত্রে স্বার্থান্ধ মানুষের চক্রান্তেও ঘটে, কিন্তু এই বারের দুর্যোগ বুঝাইয়া দিতেছে—অস্ট্রেলিয়ার দাবানলকে দুঃস্বপ্নের ন্যায় করিয়া তুলিয়াছে জলবায়ু ও পরিবেশের ক্রম-অবনতিই। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁহার দেশের ভূমিকা আছে, স্বীকার করেন না প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। অথচ সারা বিশ্বে সর্বাধিক কয়লা রফতানি করে অস্ট্রেলিয়া, খনিশিল্পের উপর দেশের শাসকেরা নির্ভর করিয়া থাকেন, এই সকলই দিবালোকের ন্যায় সত্য। দুর্ভাগ্যের কথা, কার্বন নিঃসরণ কমাইয়া পরিবেশকে সহনীয় করিবার কথা উঠিলে প্রধানমন্ত্রী উড়াইয়া দেন; দেশের কয়লানির্ভরতা, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ, দাবানল-দুর্যোগ ও জনজীবনে তাহার প্রভাবের মধ্যে কেহ যোগসূত্র খুঁজিতে গেলে এড়াইয়া যান।
অস্ট্রেলিয়ার পরিবেশ, জীববৈচিত্র, আবহাওয়ার বিশিষ্টতা হয়তো সমস্ত দেশের নাই। এই দাবানলের ন্যায় দুর্যোগও সকল দেশে আসিবে না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার দহনকাণ্ড হইতে অন্য দেশগুলি শিক্ষা লইতে পারে, কী কী পদক্ষেপ করিলে ঋতুচক্রের স্বাভাবিক আবর্তন নিশ্চিত হয়; দীর্ঘায়িত গ্রীষ্ম বা নিতান্ত বৃষ্টিহীনতাই অভ্যাস হইয়া না দাঁড়ায়; ক্ষুদ্র পতঙ্গ হইতে বৃহৎ প্রাণীটি পর্যন্ত বাস্তুতন্ত্রের সকল উপাদান সহজ জীবনটি বাঁচিতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু বাহ্যপ্রকৃতিকেই নহে, আলোড়িত করে মনোজগৎকেও। অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রেই দেখা গিয়াছে, দাবানলের পরে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা বাড়িয়াছে ৫-১৫ শতাংশ। দেশের ও দশের শরীর-মন ভাল রাখিবার লক্ষ্যে সুষ্ঠু জলবায়ু ও পরিবেশনীতির বিকল্প নাই, বুঝিলেই মঙ্গল।