বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী।
কৃষ্ণনগর গভর্ণমেন্ট কলেজের ভিত্তিস্থাপন, বিধবাদের পুনরায় বিবাহের ব্যবস্থা, শিক্ষার বিস্তার, একাধিক সমাজ সংস্কার আন্দোলনে নদিয়া জেলার ব্রাহ্মসমাজ নিজেদের ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন কৃষ্ণনগরে, শান্তিপুরে, কুমারখালিতে (বর্তমানে বাংলাদেশে), তেহট্টে, চাকদহে, শিবনিবাসে। শান্তিপুর অঞ্চলে ব্রাহ্মসমাজের সামাজিক সংস্কারমূলক আন্দোলনের ধারা অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিল ভিন্ন একটি কারণে। যাঁকে কেন্দ্র করে শান্তিপুরের এই কর্মকাণ্ড ফলদায়ী হয়ে উঠতে পেরেছিল, তিনি শিক্ষিত ও উদারমনা ব্যক্তিত্ব শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী।
বনেদিয়ানায় বিজয়কৃষ্ণ ছিলেন শান্তিপুরের শ্রী অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পরিবারে জন্ম। উচ্চশিক্ষার জন্য এক সময়ে তিনি চলে এসেছিলেন কলকাতায়। সাহিত্য বেদান্ত দর্শন নিয়ে তন্বিষ্ট পড়াশোনা করার পর বিজয়কৃষ্ণের মনে হয়েছিল, আচারনিষ্ঠ পৌত্তলিক হিন্দুধর্মের মধ্যে সারবত্তা আদৌ কিছু নেই। জাতপাতের কুসংস্কার থেকে মুক্তি চাই। আর তার আশ্রয় মিলতে পারে একমাত্র ব্রাহ্মধর্মে। অসম বিরোধিতা করেই তিনি সদস্য হয়ে গেলেন ব্রাহ্মসমাজের। দায়িত্ব পেলেন ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম প্রচারকের। শান্তিপুরে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা ও সমাজ সংস্কারমূলক কাজগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকেই পাখির চোখ করে তুললেন তিনি। যাত্রা হল শুরু।
বিজয়কৃষ্ণের মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষকে ব্রাহ্মধর্মে যুক্ত হতে দেখে সাহস করে একে একে এগিয়ে এলেন শান্তিপুরের একাধিক কৃতবিদ্য মানুষ। দীর্ঘ তালিকার কয়েক জন, ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, অঘোরনাথ গুপ্ত, ভুবনমোহন গুপ্ত, রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ডাক্তার অভয়চরণ বাগচী, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, বীরেশ্বর প্রামাণিক, হরেন্দ্রনাথ মৈত্র, পুণ্ডরীকাক্ষ মুখোপাধ্যায়, প্রাণনাথ মল্লিক, যোগানন্দ প্রামাণিক প্রমুখ। ১৩০৪ বঙ্গাব্দে শান্তিপুর মতিগঞ্জের কাছে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার সময় প্রথম আচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হল রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশকে। এক ঝাঁক শিক্ষিত মুক্তমনা যুবাপুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঘুণধরা সমাজকে অশিক্ষা, কুসংস্কার ও জাতপাতের সঙ্কীর্ণতা থেকে তুলে আনার কাজে। বিচলন উঠল শান্তিপুরের ভক্তি রসসাগরে, ভরা কোটালের মতো।
সাহায্য ও প্রতিরোধ দুই-ই লক্ষ করা গেল ব্রাহ্মদের এই সমাজ সংস্কার আন্দোলনে। শান্তিপুরের একটা বড় অংশের মানুষ ব্রাহ্মদের এই আন্দোলনকে খুব উদারতার সঙ্গে মেনে নিতে পারলেন না। কথাটা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। প্রথম আঘাতটা এসেছিল নব্য ব্রাহ্মদের নিজের পরিবার থেকে। আত্মীয় পরিজন থেকে অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখা 'শান্তিপুর পরিচয় ' গ্রন্থে তার সম্যক বিবরণ রয়েছে। সে কালের দু'একটি পত্রপত্রিকাতেও ব্রাহ্মদের নিয়ে নানা অকথা কুকথা বেরিয়েছিল। ব্রাহ্মদের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত আইন আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল বলে জানা যায়। পাহাড়প্রমাণ প্রতিরোধ সত্ত্বেও পিছু হঠার পাত্র ছিলেন না বিজয়কৃষ্ণ। প্রিয় বন্ধু প্রাণকৃষ্ণ মল্লিকের সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে গিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ফেললেন কাঁধে ঝোলানো উপবীত। ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের শেষ চিহ্নটুকু নিশ্চিহ্ন করে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এক ক্রোধী যুবক নিজেই হয়ে উঠলেন নিজের ভাগ্যদেবতা।অবশ্য সে সাহস আগেই দেখিয়ে ছিলেন কৃষ্ণনগরের আরেক সুসন্তান রামতনু লাহিড়ী। বন্ধন গেল টুটে। শান্তিপুরের সমাজ বিজয়কৃষ্ণের এই উদ্ধত ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতা ভাল ভাবে মেনে নেয়নি সে দিন। অবশ্য তা নিয়ে বিজয়কৃষ্ণের তেমন কোনও হেলদোল ছিল না।
বৈষ্ণবীয় ঘরাণায় কীর্তন গানের আঙ্গিকে ব্রাহ্মধর্মের মূল কথাগুলি পরিবেশনে একটা স্বতন্ত্র ধারা এনেছিলেন বিজয়কৃষ্ণ। আসলে শান্তিপুরের মাটিতে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও প্রসারে কীর্তনগানের যে জনমোহিনী শক্তি আছে, তা বিজয়কৃষ্ণের অজানা ছিল না। শ্রুতপূর্ব সেই অভিজ্ঞতাকে ব্রাহ্মধর্ম প্রসারের কাজে লাগালেন তিনি। ভালই চলছিল ধর্মপ্রচার ও সমাজ সংস্কারের কাজ। একটানা প্রায় বারো বছর এই কাজে যুক্ত থেকে শান্তিপুরের ব্রাহ্মসমাজের সদস্য সংখ্যা তিনি অনেকটাই বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু হঠকারিতার একটা প্রবণতা হয়তো ফের বিজয়কৃষ্ণকে ভিন্ন নক্ষত্রগামী করে তুলল। ব্রাহ্মসমাজের শিরোমণি কেশবচন্দ্র সেনকে যে দিন ব্রাহ্মরা অবতার জ্ঞানে পুজোআর্চা শুরু করে দিল, সে দিন তার তীব্র বিরোধিতা করলেন বিজয়কৃষ্ণ। বিরোধ এতটাই চরমে উঠেছিল যে, শেষপর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সব রকম সংস্রব ত্যাগ করলেন তিনি। ১২৮৯ বঙ্গাব্দে পুনরায় ফিরে এলেন স্বভূমিতে বৈষ্ণবীয় ভক্তিরসের পরিচিত স্রোতে।
শান্তিপুরে ব্রাহ্মসমাজ গড়ে ওঠার পর থেকে যে সমাজসংস্কার মূলক কাজগুলি মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রেখেছে, সেগুলি হল অনাথ আশ্রম স্থাপন, ব্রাহ্মমিশন বিদ্যালয় স্থাপন, ডায়মন্ড জুবিলি ইনস্টিটিউশন (আজকের শান্তিপুর ওরিয়েন্টাল একাডেমি), শান্তিপুর শিক্ষয়িত্রী বিদ্যালয়, আত্মোৎকর্ষ বিধায়িনী সভা, বালবিদ্যোৎসাহিনী সভা ইত্যাদি। প্রসঙ্গত মনে পড়বে, বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ আন্দোলনে নেমেছেন, তখন সেই আন্দোলনের সমর্থনে ব্রাহ্মদের সহযোগিতায় সবচেয়ে বেশি সই সংগ্রহ করা গিয়েছিল এই শান্তিপুর থেকেই। মোট স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ছিল ৫৩১।সংখ্যাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শান্তিপুরের তাঁতিরাও এগিয়ে এসেছিলেন সমাজ সংস্কারের সেই জোয়ারে। কাপড়ের পাড়ে তাঁরা বুনে দিলেন 'বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে'। জানা যায়, ব্রাহ্মদের উদ্যোগে সে কালে বেশ ক'টি বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল শান্তিপুরে। আর সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী হয়েছিলেন কৃতবিদ্য বিজয়কৃষ্ণ। তাঁর ডাকেই কুমারখালি থেকে ছুটে এসেছিলেন 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' পত্রিকার সম্পাদক হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙাল হরিনাথ। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই বিজয়কৃষ্ণ ব্রাহ্ম গান পরিবেশনের জন্য ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকা, রাজশাহী ও কলকাতায়। এক সময় শান্তিপুরের রাস উৎসবের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল অশ্লীল খেউড় গান ও আদিরসের বেলেল্লাপনা। বিষয়টা ভাবিয়ে তুলেছিল শান্তিপুরের প্রগতিশীল ব্রাহ্ম যুবকদের। 'সোমপ্রকাশ' পত্রিকায় এই অশ্লীলতা প্রসঙ্গে লেখা হয়েছিল, "শান্তিপুরে যদি একটি করে ইংরেজি ও বাংলা বিদ্যালয় এবং একটি ব্রাহ্মসমাজ না থাকিত তবে শান্তিপুর শ্রীকৃষ্ণের অকূল সাগরে ভাসিয়া যাইত।" কথাটির সত্যতা আজও সমান ভাবে অটুট।
আরেকটি কথা। ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবারা সে কালে একাদশীর দিন নির্জলা উপোস করতেন। সামাজিক এই নির্মম বিধানের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়ছিলেন ব্রাহ্মরাই। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রজনীকান্ত মৈত্রের মতো মুক্তমনা যুক্তিবাদী ব্রাহ্মণ সন্তানেরা। গোড়ার দিকে শান্তিপুর থেকে ব্রাহ্মরা একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। সেটির নাম ছিল 'যুবক'। পত্রিকাটি পরে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শান্তিপুরের ব্রাহ্মসমাজ আলোর পথ ধরে যে যাত্রা শুরু করেছিল একদি, সে পথের আলো আজও সমান ভাবে অনির্বাণ।ইতিহাসের পাতা ওল্টালে এখনও সে আলোর রেখা ভেসে উঠবে উৎসুক দৃষ্টিপথে।