কাকে বলে পুজো? ক্যালেন্ডারে দাগানো চারটে দিন? না কি গোটা বছর জোড়া একটা একটা স্মৃতির অ্যালবাম? সেই স্মৃতি জানত, আমায় চলে যেতে হবে বহু দূর? ‘যেতে নাহি দিব’ বলে কেউ আটকে রাখেনি আমায়। হয়তো-বা আমার শিকড় জানত ‘আমি ভালবাসি যারে, সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে?’
বৃষ্টি, মায়ের হাতে বেগুনি আর রেডিয়োয় শ্যামল মিত্রের গানের দিনগুলো ফুরিয়ে গেলে মনে হত এ বার পুজো। ঘুম থেকে উঠে প্রথম রোদটা মনে করাত বই-খাতার সঙ্গে বিচ্ছেদের আর তো বেশিদিন বাকি নেই। স্কুলে শুরু হয়ে যেত পঞ্চমীর রিহার্সাল। ক্লাসের মাঝখানে বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে যাওয়া— ‘আমার প্র্যাকটিস আছে’। একটা ক্লিপ আর টিপের পাতা ভরা খামেই মিশে থাকত আমাদের আন্তরিকতা। দিনে তিন-চার বার নতুন জামাগুলোকে জড়িয়ে ধরতাম। ভরতনাট্যম শেষ হয়েছে বহুদিন। স্টেজ ভুলেছে আমায়, ভুলেছি আমিও।
কিন্তু ভুলতে পারিনি আমার হামাগুড়ি দেওয়া মেঝে, আমার বড় হওয়ার রাস্তাগুলোকে। একদিন একটা ট্রেন আমায় নিয়ে গিয়েছে বহুদূরে। পিছন ফিরে দেখেছি বহুবার। একটার পর একটা পুজো এসেছে। বদলায়নি কিচ্ছুটি। পাড়ার মাঠটা শান বাঁধানো হয়ে গিয়েছে। তবু সেই কাদা মাখা ঘাসে, খানদশেক চেয়ারেই বাঁধা থেকে গিয়েছে আমার পুজো। তখন নতুন নতুন সালোয়ার পরতে শিখেছি। গুছিয়ে ওড়না। শাড়ি পরলে হাজারটা সেফটিপিন। সাতটা নাগাদ বাবা বসিয়ে দিয়ে যেত পাড়ায়। ন’টা বাজলেই আবার মা নিয়ে যেত। তার মাঝে দাঁত চলত, মুখও। আপাদমস্তক দেখতাম সদ্যবিবাহিত প্রথম পুজোর দম্পতিকে। তখন সেলফি হয়নি। গ্যালারিতেও সেভ হত না কিছু। কই, ভুলিনি তো কিছু? দু’টাকায় ছ’টা ফুচকা, তিন টাকার চুরমুর, পাঁচ টাকার চিকেন পকোড়া— বরাদ্দ তখন ওইটুকুই। তাতেই মুখে রাজ্যজয়ের হাসি। আবার একটা সকাল, অঞ্জলি, খিচুড়ি। পাটভাঙা শাড়ি আর ফলের গন্ধ মিশে কী অদ্ভুত একটা পরিবেশ তৈরি হত! মনে হত, এটাই সত্যি! আর কিছু নয়!
পাড়ার আড্ডায় লাল-রঙা একটা চেয়ার থাকত ঠিক মাঝখানে। ওই চেয়ারে যে বসত, দেখতে পেত সকলকে— সেই যেন রাজা! আমাদের নজর থাকত সেই চেয়ারটার দিকেই। ওটাই আমাদের সিংহাসন। ‘রাজা হলেই রাজাসনে বসে, রাজাসনে বসলেই রাজা হওয়া যায় না’— শিখিনি তখনও।
আবার আমাদের পাশের চেয়ারগুলোই মায়েদের। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছি। আমাদের জামার ধরন বদলেছে, আলোচনারও। আড় চোখে দেখে নিয়েছি বন্ধুর দাদাকে। প্রহরী বসিয়ে চলে গিয়েছি পাশের মণ্ডপে। তখনও একই থেকে গিয়েছে ওই মাঠটা। সেখানে মুখোমুখি বসেই লুচি খেয়েছি। আরতি দেওয়ার জন্য অপটু হাতে পঞ্চপ্রদীপ তুলে নিয়েছি। ভোগ দিয়েছি যত, ছড়িয়েছি তত বেশি। সাদা মেঘের ভেলা, পুজো পরিক্রমা, খবরের কাগজে ‘আজ মহাষষ্ঠী’ আর তারপরেই বাজল ছুটির ঘণ্টা। দুঃখটা বুঝতে বুঝতে একাদশী হয়ে যেত। কারণ, দশমীর দিনটাও গমগম করত লোক। পাড়া-প্রতিবেশী, বাবার ছাত্রেরা, আত্মীয়স্বজন। একদিকে পিসি নাড়ু বানাচ্ছে, একদিকে মা আলুর দম।
তারপরেই আস্তে আস্তে সব যেন বদলে গেল। ‘সোনাডাঙা মাঠ ছাড়িয়ে, ইছামতী পার হয়ে..... বেত্রবতীর খেয়ায় পাড়ি দিয়ে’ আমিও দূরে চলে গিয়েছি অনেকটা। যক্ষপুরীর সোনালি মায়া গ্রাস করেছে আমাকেও। ভেবেছিলাম, আমায় ছাড়া ম্লান হয়ে যাবে এই পুজো। কিন্তু হয়নি। এখনও গান বাজে ‘ফিরে এলাম, দূরে গিয়ে’, মাইকে শোনা যায় ‘খিচুড়ি দেওয়া শুরু হল’। এখনও ‘বাড়ির মাথায় মাথায় মেঘ দাঁড়িয়ে দারুণ সাদা ধুতি পাঞ্জাবিতে/ বাচ্চাগুলো ক্যাপ ফাটাচ্ছে/ নতুন জুতো ফোস্কা পরা/ কারওর হাতে প্লাস্টিক হাতঘড়ি...লালপেড়ের গরদ আর পাকা চুলের জ্বলজ্বলে সিঁদুর...’। আসলে, কেবল ‘আমরা ফুরায়ে যাই...’।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)