শহর যত স্মার্ট হয়েছে, গরিব মানুষের জায়গা ততই কমেছে
India Lockdown

বন্দি থাকার ঘর নেই যাঁদের

স্পেস বা স্থান, নগরে এবং গ্রামেও অতি মহার্ঘ বস্তু। কেবল মাথাপিছু আয়ই নয়, সঞ্চয়ের পরিমাণের উপর নির্ভর করে ক্রয়ক্ষমতা।

Advertisement

অনিতা অগ্নিহোত্রী

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২০ ০১:১৯
Share:

খবর বা বিজ্ঞাপন যাই চলুক টেলিভিশনে, পর্দার নীচে চলতে থাকে সাবধানবাণী— ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন। একে মারণ ভাইরাসের আতঙ্ক, তার সঙ্গে লকডাউন। নিরাপদ থাকার জন্য প্রয়োজন ঘরে থাকা, তাও বয়স্ক বা রোগীদের থেকে দূরত্ব রেখে।

Advertisement

কিন্তু, কত জনের আছে তেমন ঘর, যেখানে বন্ধ হয়ে থাকা যায় চব্বিশ ঘণ্টা, একনাগাড়ে একুশ দিন? আনাজ-চাল-ডাল কিনতে বাইরে পা রাখলে, পুলিশের উঁচানো লাঠি। তারকারা সোশ্যাল মিডিয়াতে উৎসাহজনক ছবি পোস্ট করছেন, কী ভাবে দিগন্তবিস্তৃত রান্নাঘরে তাঁরা রান্না করছেন, অথবা ঘরের মধ্যে থেকে ব্যায়াম। এই ফাঁকে নিজের ডিজ়াইনার বাড়িখানিও পাবলিককে দেখানো হল। সত্যি তো, ঘরে তাঁরা প্রায় থাকেন না বললেই হয়। যদিও ওই রকম এক-একখানি ঘর থাকলে বাইরে না বেরোলেও চলে!

স্পেস বা স্থান, নগরে এবং গ্রামেও অতি মহার্ঘ বস্তু। কেবল মাথাপিছু আয়ই নয়, সঞ্চয়ের পরিমাণের উপর নির্ভর করে ক্রয়ক্ষমতা। কিন্তু কেনার কথা বহু দূর, আশি শতাংশ গরিব থাকেন ভাড়া ঘরে, এবং সারা দেশের সব শহরে গজিয়ে ওঠা বস্তিতে। কেমন সে-সব বস্তির চেহারা? গায়ে গায়ে আট ফুট বাই আট ফুট ঘর, মাঝে খোলা নর্দমা বা বর্ষার জলস্রোত, বারোয়ারি স্নান ও শৌচের ব্যবস্থা। ভাড়ার অঙ্কের তারতম্যে আলাদা ব্যবস্থাও থাকে। এমন সব বস্তি অথবা বাসায় থাকেন আমাদের সংসারচক্রের চালক-চালিকারা, এ ছাড়া অসংখ্য বিক্রেতা, মেকানিক, পণ্য সরবরাহকারী। শহরের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ গরিব। বস্তিতে থাকেন এঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। গরিব বলে তাঁরা পরমুখাপেক্ষী নন। তাঁদের দেওয়া সুলভ মূল্যের পরিষেবাতেই চলে আমাদের, সম্পন্নদের সংসার।

Advertisement

ঘরে সব সময় থাকার অভ্যেস তেমন নেই আমাদের। লকডাউন বলে ঘরে থাকতে হচ্ছে। সবাইকে সুস্থ থাকতে হলে যাঁদের ঘর বসবাসের অযোগ্য, অপরিসর বা ছোট, তাঁদেরও থাকতে হবে ঘরের ভিতর। দেখলেই বোঝা যায়, গরিবদের ওই সব ঘর বানানো হয়েছে শীতের রাতটুকু কোনও মতে কাটানোর জন্য। বাকি সময়টা ঘরের আশেপাশে বাজার-হাটে চায়ের দোকানে এবং কাজের জায়গায় কাটানো। কাজেই ঘরে ঢোকাটা তেমন জরুরি নয়।

২০১২ সালের পরিসংখ্যান— তখন আড়াই কোটির মতো ঘরের অভাব ছিল দেশে। ঘরের অভাব বলতে যে মাথার উপর মোটে ছাদ নেই, তা নয়। এই আড়াই কোটির মধ্যে আছেন গৃহহীনরা, যাঁদের ঘর পড়ো-পড়ো, বা কাঁচা, বা অস্বাভাবিক ভাবে ঠাসাঠাসি বাসস্থান। আবার এটাও সত্যি যে, দেশে কুড়ি শতাংশের মতো বাড়ি তালাবন্ধই পড়ে থাকে সম্বৎসর। মালিক থাকেন না, ভাড়াও দেওয়া হয় না। এটা বাজার ব্যবস্থারই অসঙ্গতি।

গত দু’দশক ধরেই, দেশি ও বিদেশি পুঁজির পথ প্রশস্ত হওয়ার পর থেকেই, নগরায়ণ আরম্ভ হয়েছে বিপুল গতিতে। আজকাল মেট্রো না হলে ছোট শহরেরও মান থাকে না। তার উপর হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা— স্মার্ট সিটির তকমা কোন শহর পাবে এবং কী ভাবে। কিছু বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত ছাড়া স্মার্ট সিটি প্ল্যানিং-এ দরিদ্র নগরবাসীদের নিয়ে কোনও ভাবনাচিন্তা নেই। দিবারাত্র ওয়াইফাই পরিষেবা দিয়ে আরম্ভ হয়ে সাইকেল ট্র্যাকে শেষ হয় নগরচিন্তা। অথচ, সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহারযোগ্য যৌথ জায়গা কমতে আরম্ভ করেছে, ছোট-বড় সব শহরেই।

আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেও শহরে কিছু সাধারণ জায়গা ছিল, যেটা ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সবাই ব্যবহার করতে পারত। পার্ক, খেলার খোলা মাঠ, সাঁতারের জন্য পুকুর, ব্যায়াম করার আখড়া। এখন গেট বসে গেছে সর্বত্র। উচ্চমধ্যবিত্তের বাসস্থানগুলিকে আজকাল আমরা বলি গেটেড কমিউনিটি। বস্তিবাসীরা চাইলেও সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য কোনও জায়গাই খুজে পাবেন না, যেখানে তাঁরা বিনাপয়সায় আনন্দ বা খেলাধুলো করতে পারবেন। এ বিষয়ে এখনও কলকাতা কিছুটা সাম্যবাদী হলেও, অন্য মেট্রো বা বড় শহরগুলি বড়ই নির্মম। গড়পড়তা হিসেবে, শহরের বস্তিগুলি নাগরিক স্থানের বণ্টনে এক থেকে দুই শতাংশ জায়গা নিয়ে থাকে এবং দরিদ্র নাগরিকদের আশি শতাংশের জন্য বরাদ্দ এইটুকু। তার উপর, যৌথ জায়গাও এখন তাঁদের আয়ত্তের বাইরে। এই যখন সম্বৎসরের অবস্থা, তার উপর করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক ব্যবস্থা বলছে, হোম কোয়রান্টিন। বলছে, সেল্ফ আইসোলেশন। নিজের ঘরে বিচ্ছিন্নতা। যাঁদের জন্য জায়গার বরাদ্দ কমাতে কমাতে আমরা তলানিতে এনে ফেলেছি, তাঁদের জন্য সমাধান কী? সরতে সরতে দরিদ্রের পিঠ কার্যতই দেওয়ালে।

গৃহহীনদের কথা কীই বা বলা যায়? দেশব্যাপী লকডাউনে তাঁরা অনাহারে মারা যাবেন, না ভাইরাসের আক্রমণে, তা জানা নেই। ভিখারিনি মায়ের হাতে ফুরিয়ে আসা স্যানিটাইজ়ার— এর চেয়ে করুণ ভাইরাস মোকাবিলার ছবি আমাদের স্মৃতিতে নেই। যে সন্তানদের ধুলোয় খেলতে দিয়ে তাঁরা ঘরের কাজ সারতেন, আজ কোথায় পাবেন তাদের হাত ধোওয়ানোর জল?

লকডাউনের পর বলা হয়েছিল, অভিবাসী দিনমজুররা যে যেখানে আছেন, সেখানেই থাকবেন। নইলে সংক্রমণ ছড়াবে। কার্যত দেখা গেল, কাজ নেই, হাতে টাকা নেই, নেই ভিন রাজ্যে ঘর ভাড়া দেওয়ার মতো সঞ্চয়, শ্রমিকেরা বাসের অভাবে রওনা দিয়েছেন ঘরের দিকে। এখন বাসের ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু না আছে খাদ্য, না পানীয় জল। ২০১৫ সালে যখন সবার জন্য ঘরের নীতি প্রণয়নের কাজ আরম্ভ হয়েছিল, তার একটি প্রস্তাবিত অংশ ছিল অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য সরকারি ব্যবস্থায় ভাড়া ঘর বা ডর্মিটরি। নগরপালিকা এবং শিল্প সংস্থাগুলি এমন একটি ব্যবস্থা চালাতে পারত। তাতে শহরে থাকার দৈনন্দিন টানাপড়েন কম হত শ্রমিকদের জন্য। বস্তির জমি ও ঘরভাড়া নিয়ন্ত্রণ করেন আর এক দল মাফিয়া। সেখান থেকে পাওয়া কয়েকশো কোটি টাকার ঘরভাড়ার পুরোটাই কালোবাজার। বস্তি-বাসিন্দাদের বসবাসের অধিকার ও ভাড়া যদি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আসত, তা যোগ হত আমাদের জাতীয় সম্পদে।

গত চার-পাঁচ বছরে সব রাজ্যেই দরিদ্রের জন্য ঘর অবশ্য বেশ কয়েক লক্ষ তৈরি হয়েছে। কিন্তু ঘর তৈরির কাজে নেমে পোয়াবারো হয়েছে এক শ্রেণির ডেভেলপারের, যাঁরা এই শহরের স্থান-বাজারের মালিক। মন্দার সময় নির্মাণ বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে, কারণ, নতুন আবাস যোজনায় পাওয়া যায় ব্যাঙ্ক ঋণ, তার সঙ্গে ভর্তুকি। পরবর্তী কালে, গরিবের নামে বুক করা অজস্র ঘর চড়া দামে কিনে নেবে উচ্চ মধ্যবিত্ত, যাদের মাথাপিছু আবাস এখন একাধিক। এমন বহু নতুন আবাস শহরের প্রত্যন্ত এলাকায় তৈরি হয়েছে। সেখানে জীবিকার সুযোগ সীমিত। আবার যানবাহনও নেই কাজের জায়গায় পৌঁছনোর মতো। ফলে দিনমজুরি বা অল্প আয়ের কাজ যাঁরা করেন, তাঁরা সেখানে থাকতে পারবেন না। জমির দাম যে হেতু বাজারের নিয়ন্ত্রণে, শহরের ধনীরা দরিদ্রদের তফাতেই রাখবেন, এবং অতি নগণ্য পরিসরে।

দারিদ্র নিয়ে আলোচনার সময় এ নয়। এখন দেশের বিপদ। কিন্তু পুরো দেশটাকে মুড়ে ঘরে তুলে দেওয়াও খুব কঠিন কাজ, যখন দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের নেই পুরো দিন কাটাবার মতো ঘর। ২০১৮ সালে গৃহ ও নগরী দারিদ্র উন্মূলন বিভাগটি লুপ্ত হয়ে মিশে গেছে নগর বিষয়ক মন্ত্রকে। নামে কি কিছু আসে যায়? কারণ, ২০১২-র পরের গৃহ সঙ্কট বিষয়ক পরিসংখ্যান নেই। সুপ্রিম কোর্ট শহরে আশ্রয় পরিষেবা নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দিয়েছিল ২০১৪ সালে। বহু আর্বান শেল্টার গড়ে উঠেছিল। সেখানে এখন অভিবাসী শ্রমিকদেরও খাবার দেওয়া হচ্ছে।

গরিবরা গৃহবন্দি না হলে, আমরাও বিপন্ন, তাঁরাও। যাঁদের পিছনে রেখে এগোব মনে করেছিলাম, তাঁরাই এখন আমাদের পশ্চাতে টেনে রাখতে পারেন। করোনাভাইরাস চলে গেলে হাত ধোওয়ার মতো, ভিড়ে না যাওয়ার মতো স্বাস্থ্যকর অভ্যাস আমাদের রয়ে যেতে পারে, কিন্তু অর্থনৈতিক সাম্যের অভ্যাস করতে গেলে যে পুনর্বণ্টন নামক ত্যাগ প্রয়োজন, তা এত সহজে হবে না।

গভীরতর অসুখ তাই থেকেই যাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement