ইলন মাস্ক। ফাইল চিত্র।
কোম্পানির কর্ণধার হিসেবে যিনি চূড়ান্ত অনির্ভরযোগ্য, কারণে অকারণে মাথা-গরম, নেতৃত্বদানে দুর্বল, যাঁর সম্পর্কে চালু বিশেষণ হল উদ্ভ্রান্ত বা ‘কেয়টিক’ অথবা স্বপ্ন-ব্যবসায়ী বা ‘ড্রিম মার্চেন্ট’— তাঁকে নিয়ে বছর-শেষে বেশি কথা বাড়িয়ে লাভ কী? তাঁকে এত গুরুত্ব দেওয়াই বা কেন?
কঠিন প্রশ্ন। কিন্তু সমস্যাজনক চরিত্রদের নেতিবাচক কাহিনিগুলিও হয়তো মন দিয়ে ভাবতে হয়, বিচার করতে হয়। হয়তো তাতে লুকিয়ে থাকে বড় কিছু অর্থ, চলমান সময়ের অভিজ্ঞান। ইলন মাস্ক সেই রকমই এক জন। তিনি কেবল একক ব্যক্তি নন। আমাদের বিশ্বসভ্যতা ২০২২ সালের শেষে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তিনি সেই সময়ের এক প্রতীকী মুখ।
ইলন মাস্ক টুইটারের প্রধান হয়েছেন ২৭ অক্টোবর। তার পর গত দুই মাসে এতই হম্বিতম্বি এবং গোলমাল পাকিয়েছেন তিনি যে পৃথিবী জুড়ে তাঁর নাম শোনা গেছে প্রত্যহ। কী করেননি তিনি এই স্বল্প সময়ে? ‘মাস লে-অফ’— এক ঘায়ে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ (হাজার চারেক) টুইটার-কর্মীর চাকরি গিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাতিল টুইটার অ্যাকাউন্ট মাস্ক নিজ দায়িত্বে আবার ফিরিয়ে এনে তীব্র বিতর্ক উস্কেছেন। ‘ভেরিফায়েড টুইটার অ্যাকাউন্ট’-এর জন্য মূল্য ধার্য করেছেন, এবং তার পর, নানান গোলযোগ আর প্রবল নিন্দেমন্দের চাপে পড়ে সেই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছেন। এই সব বড় বড় ঘটনাই ঘটেছে সোজাসুজি টুইটারে, পাবলিকস্য পাবলিক সমাজমাধ্যমে— অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাস্ক-এরই একের পর এক টুইটের মাধ্যমে। তাই, ট্রাম্প যেমন এখন আর এক জন ব্যক্তিমাত্র নন, তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু, এবং সেই ‘বেশি কিছু’টাকে নাম দিয়েছি আমরা ‘ট্রাম্পিজ়ম’, তেমনই আর কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো এসে যাবে নতুন শব্দ ‘মাস্কিজ়ম’।
এ দিকে দু’মাসের মধ্যেই তাঁর অতিকায় কর্পোরেট সংস্থার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হল যে, ইলন মাস্ককে বলতে হল ‘সকলে চাইলে’ তিনি পদত্যাগ করবেন! এখানে একটা ঝুঁকি নিলেন বটে মাস্ক। ১৮ ডিসেম্বর বড় গলা করে এই ‘গণতান্ত্রিক’ নিদান হাঁকার সময়ে সম্ভবত ভাবলেন না যে, ‘আপনারা কি চান যে টুইটারের প্রধান পদটি আমি ছেড়ে দিই?’ এই আত্মম্ভরি প্রশ্নের উত্তরে সত্যিই ‘নো’-এর চেয়ে ‘ইয়েস’ টুইট আসতে পারে বেশি! ঘটনা হল— পৌনে দুই কোটি টুইটে ভেসে এল ৫৭.৫ শতাংশ ‘ইয়েস’!
স্বপ্ন দেখাতে পারেন মাস্ক, কিন্তু স্বপ্ন ‘বেচা’ আর স্বপ্ন ‘বাস্তবায়িত করা’ এক নয়, দ্বিতীয়টা তিনি তত পারেন না, হয়তো তাই লোকে বলে ‘সাকসেসফুল ফেলিয়োর’-এ সাজানো তাঁর কেরিয়ার-পথ। টুইটারকে অর্থকরী করতে নেমে এমনকি উপস্থিত বিজ্ঞাপনদাতাদেরও বিমুখ করে দিলেন তিনি। কিন্তু তাতে কী। সব ব্যর্থতা ব্যর্থতা নয়। ফেলিয়োর-ও সাকসেসফুল হয়। আপাতত তিনি সঙ্কটাপন্ন, কিন্তু এক দিক দিয়ে তিনি খুবই সফল— দেখিয়ে দিয়েছেন আজকের জগৎজীবন চালানোর কৌশলটা কী রকম। চটজলদি তাক-লাগানো সিদ্ধান্ত, বহু মানুষকে রাতারাতি রোজগারহীন করে ব্যবসায়িক জুয়া খেলা, মানুষকে অনবরত ভুল বোঝানো, ট্রাম্পের মতো লোকদের অন্যায়কারী জেনেও তাঁদের ক্রমাগত তোল্লাই দিয়ে ভক্তসমাজের মনোরঞ্জন থেকে ব্যবসায়িক লাভ— এ সব তো কেবল ইলন মাস্কের একার কাজকর্ম ভাবনাচিন্তা নয়, একুশ শতকের তৃতীয় দশকের সমাজমাধ্যম-শাসিত ও সংবাদমাধ্যম-বাহিত বিশ্বেরই ধরন এটা। এই পথেই ওঠা, এই পথেই পড়া— কিন্তু পথটা এটাই। টুইটারের ‘হেট স্পিচ’-এর বাড়বাড়ন্তটাকে অকারণ বলা যায় না। চটজলদি ঘৃণার প্রচার যে ব্যবসার পক্ষে ভাল, এ তো কেবল মাস্কের বৈশিষ্ট্য নয়, টুইটারের নীতি নয়। এ হল বিশ্বরীতি।
কিছু দিন ধরে শোনা যাচ্ছে, মাস্ক নাকি উইকিপিডিয়াও কিনে নিতে পারেন। অথচ উইকিপিডিয়া ঠিক ক্রয়যোগ্য বস্তু নয়, এটা অ-ব্যবসায়িক। তাই এই প্রচার অন্তত এখনও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবু কেন এই অসত্য প্রচার? কেননা উইকিপিডিয়ার বেশির ভাগ ‘এডিটর’ই ‘লিবারাল’, তাঁরা মাস্কের বিষয়ে ভাল ধারণা পোষণ করছেন না দেখে মাস্ক-ভক্তরা এই প্রচার চালাচ্ছেন। ফেক নিউজ় কী ভাবে ব্যবসা-জগতে ফাঁপা বুদবুদ তৈরি করে, এ তারই দৃষ্টান্ত। মাস্ক জানেন, সবটা তাঁকে একা হাতে করতে হবে না, করে দেবে তাঁর ‘পন্থী’রাই। এই হল ‘গণতন্ত্র’। আর তাই, মাস্ক এক হাতে একনায়কের মতো কোম্পানি চালান, অন্য দিকে মুখে লাগাতার ‘ফ্রি স্পিচ’-এর জয়গান করেন।
এ সমস্তই এই সময়ের অভিজ্ঞান। অভাবনীয়ের চকিত কিরণ আমদানি করা সমাজমাধ্যমের ভার্চুয়াল শাসনাধীন বিশ্বজগৎ। সেই জগতে নিশ্চয়ই ওঠাপড়া আছে। খানাখন্দ আছে। ইন্টারনেট যুগের মূল বৈশিষ্ট্য যদি হয় ‘ইউজ়ার-জেনারেটেড কনটেন্ট’, তা হলে ‘পিক ওয়েব ২.০’-তে টুইটার এখন একটা খন্দের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খানাখন্দ সত্ত্বেও পথ তো এটাই। ‘গণতন্ত্র’বুলির আড়ালে এ ভাবেই চলবে গণস্বার্থনাশের কারখানা। মানুষের দুর্বলতা বুঝে নিয়ে তা নিয়ে মিথ্যের বেসাতি, আর সংস্কারনিমজ্জিত মানুষের অ-জ্ঞান অদক্ষ হাতে সেই বেসাতি ছেড়ে দেওয়ার গৌরব, দুই-ই আজকের দুনিয়াদারির রকমসকম।