‘স্বাভাবিক’

প্রতিবেশী মানুষের দুর্দশা সহ্য না করিতে পারিয়া বাহির হইয়া আসিবার দণ্ড দিতেছেন ওই চিকিৎসক— স্বাভাবিকতার এমনই হাল। স্বাধীনতা গিয়াছে সংবাদমাধ্যমেরও। কাশ্মীরের সাংবাদিকরা অনেকেই গ্রেফতার, বা গৃহবন্দি, বা জিজ্ঞাসাবাদে নাস্তানাবুদ। রাজ্যপাল বলিয়া দিয়াছেন, দরকারে টেলি-যোগাযোগব্যবস্থা এখন বন্ধ থাকিবে। অর্থাৎ, ‘স্বাভাবিকতা’ বলিতে ভারতীয় নাগরিক যাহা বুঝিয়া থাকেন, কাশ্মীর তাহা হইতে বহু দূরে। 

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৯ ০০:০৭
Share:

দিল্লি হইতে অনেক বাক্য ধ্বনিত হইতেছে কাশ্মীর প্রসঙ্গে— সবই অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কোনও ঝামেলা নাই, উপত্যকায় শান্তি বিরাজ করিতেছে। ফোন বা ইন্টারনেট বন্ধ থাকিতে পারে, কিন্তু প্রাণহানি হইতেছে না। পরিস্থিতি একেবারে স্বাভাবিক। রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক হইতে শুরু করিয়া বিজেপি মন্ত্রিবর্গ, সকলেরই এক রা। সিদ্ধান্ত করা যায়, পরিস্থিতির ‘স্বাভাবিকতা’ বলিতে তাঁহারা কেবল বোঝেন প্রাণহানি হইতেছে কি না। অথচ, স্পষ্ট করিয়া কিছু জানিবার উপায় না থাকিলেও অস্পষ্ট ইশারা ও টুকিটাকি খোঁজখবর বলিতেছে, সেখানে স্বাভাবিকতার লেশমাত্র নাই। সাধারণ মানুষ কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া বাধ্যতামূলক ভাবে ঘরের মধ্যে থাকিতেছেন। কয়েক হাজার মানুষ বিনা দোষে, স্রেফ সন্দেহবশে, গ্রেফতার হইয়াছেন। বিনা কারণে বাবা-মায়ের সম্মুখ দিয়া অপরিণতবয়স্ক ছেলেদের উঠাইয়া লওয়া হইতেছে। অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার আশা নাই। সংবাদ বলিতেছে, জনৈক ডাক্তার যখন প্রকাশ্যে বিবৃতি দিতেছিলেন কী ভাবে ক্যানসার আক্রান্ত মানুষ কেমোথেরাপি বন্ধ হওয়ায় বিপদগ্রস্ত— মিনিট কয়েকের মধ্যে সেনাবাহিনী তাঁহাকে ধরিয়া অজানা ডেরায় লইয়া গিয়াছে, পরিবারের কেহ এখনও জানেন না তাঁহার কী গতি হইল। প্রতিবেশী মানুষের দুর্দশা সহ্য না করিতে পারিয়া বাহির হইয়া আসিবার দণ্ড দিতেছেন ওই চিকিৎসক— স্বাভাবিকতার এমনই হাল। স্বাধীনতা গিয়াছে সংবাদমাধ্যমেরও। কাশ্মীরের সাংবাদিকরা অনেকেই গ্রেফতার, বা গৃহবন্দি, বা জিজ্ঞাসাবাদে নাস্তানাবুদ। রাজ্যপাল বলিয়া দিয়াছেন, দরকারে টেলি-যোগাযোগব্যবস্থা এখন বন্ধ থাকিবে। অর্থাৎ, ‘স্বাভাবিকতা’ বলিতে ভারতীয় নাগরিক যাহা বুঝিয়া থাকেন, কাশ্মীর তাহা হইতে বহু দূরে।

Advertisement

প্রশ্ন উঠিবে, এতখানি বজ্র আঁটুনির কারণ কী। কেন রাহুল গাঁধী হইতে সীতারাম ইয়েচুরি, সকল নেতাকে এই ভাবে আটকানো হইতেছে। শেষ অবধি ইয়েচুরি যদিও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশবলে বলীয়ান হইয়া শ্রীনগরে অবতরণ করিয়াছেন, তাঁহাকে গন্তব্যে লইয়া যাইতে পুলিশপ্রহরার ব্যবস্থা হইয়াছে। স্পষ্ট বোঝা যায়, এত সবের দরকার হইতেছে প্রতিবাদ-আন্দোলনের তীব্রতার ভয়ে, হিংসাত্মক কার্যকলাপের আশঙ্কায়। অর্থাৎ স্বাভাবিকতা বিষয়ে সরকার যাহাই বলুক, আসল কথা, কাশ্মীরকে নিজের ‘স্ব-ভাবে’ ফিরিতে দিলে সে এই নূতন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ফুঁসিয়া উঠিবে। দেশবাসী তাহা জানেন, কেন্দ্রীয় সরকার তো জানেই।

লক্ষণীয়, এই প্রতিরোধ কিন্তু কেবল পাক-সমর্থিত জঙ্গি, বিচ্ছিন্নতাবাদী, কিংবা পাথর-ছোড়া বিক্ষুব্ধ বাহিনীর দিক হইতেই আশঙ্কা করা হইতেছে না। সাধারণ শান্তিকামী জনসমাজের উপরও সরকারের যে আস্থা নাই, সংবাদমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা হইতে তাহা স্পষ্ট। সর্বোচ্চ আদালতে এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা হইয়াছে। আদালত জম্মু ও কাশ্মীর সরকারকে জবাবদিহি করিতে বলিয়াছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নাগরিক স্বাধীনতার প্রথম শর্ত। অথচ কেবল তিনশত সত্তর ধারা প্রত্যাহারের পরিপ্রেক্ষিতে নহে, তাহার বেশ কয়েক মাস আগে হইতেই কাশ্মীর উপত্যকায় সংবাদপত্রগুলির উপর চাপপ্রদান, এবং সম্পাদক ও রিপোর্টারদের উপর রীতিমতো নির্যাতন চলিতেছে। অতীব দুর্ভাগ্যজনক— যে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার প্রথম কাজ দেশময় সংবাদ-স্বাধীনতার সুরক্ষা, তাহাও এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গুলি নির্দেশেই চালিত। ভারতীয় সাংবাদিকদের বিবিধ সংগঠন কঠোর ভাষায় প্রতিকার দাবি করিলেও এখনও পর্যন্ত কাশ্মীরের সংবাদমাধ্যমের ফাঁস ঢিলা হইবার ইঙ্গিত নাই। বিচারবিভাগের নির্দেশেও যদি সরকার এই আসুরিক পরিস্থিতির পরিবর্তন না ঘটায়, তবে ভারতীয় গণতন্ত্রের সর্বনাশের ঘণ্টাটি কাশ্মীরই বাজাইতে চলিয়াছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement