জনক: মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা (ডান দিকে), ১৯৭২
বাংলাদেশের মানুষকে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রজীবন থেকেই বাংলার দরিদ্র মানুষের দুঃখযন্ত্রণা নিয়ে ভাবতেন তিনি। যে মানুষগুলি দিনের পর দিন এক বেলা খাবার জোগাড় করতে পারেন না, মাথা গোঁজার ঘর পান না, যেখানে মায়ের কোলে রোগে শোকে ধুঁকে ধুঁকে শিশুর মৃত্যু হয়, এ সব বঞ্চিত মানুষের মুক্তির কথাই ছিল তাঁর ভাবনার কেন্দ্রে। আর তাই, অসামান্য নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠার পর, বিশ্বসভায় এক স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালি জাতিকে প্রতিষ্ঠায় সাফল্যের পর, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার লক্ষ্যে তিনি চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি। ‘‘বাংলার মানুষ অন্ন পাবে, বস্ত্র পাবে, উন্নত জীবন পাবে’’— বলতেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, যাতে স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছতে পারে। বাংলাদেশে তখন ৮২ শতাংশ মানুষ বাস করেন দারিদ্রসীমার নীচে। ‘সোনার বাংলা’ বলতে বুঝতেন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত দেশ।
গণবিপ্লবের পর প্রতিটি সমাজে ও দেশে একটা বিবর্তন আসে। তার ফলে সমাজের কিছু মানুষ অর্থ-বিত্তের দিকে হঠাৎই বেশি করে ঝুঁকে পড়েন। আর যাঁরা তা করেন না, কিংবা আগে থেকেই বিত্তশালী থাকেন, তাঁরা তাল মেলাতে পারেন না। এর সঙ্গে বাংলাদেশের ছিল আর এক সমস্যা। সেখানে গেরিলা যুদ্ধ হয়েছিল। পাকিস্তানিদের হাতে-গড়া দালাল, রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী কেবল স্বাধীনতার বিরোধিতা করেনি, গণহত্যা, লুটপাট, নারীনির্যাতন ও নানা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। একা রাতারাতি বেশ পাল্টে মিশে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের সঙ্গে। অনেকই আবার কমিউনিস্ট পার্টি বা অন্যান্য আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির সঙ্গেও মিশে যায়, সমাজে তৈরি হয় একটা ব্যাপ্ত অস্থিরতা। স্বাধীনতার অর্জনকে ব্যর্থ করতে, এবং মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রতিশোধ’ নিতে তৎপর হয় তারা। আরও বিপজ্জনক যে তাদের দু’টি রূপ ছিল। প্রকাশ্যে বিশ্বস্ত ও প্রচ্ছন্নে ষড়যন্ত্রলিপ্ত— এই ভাবে তারা স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করতে মরিয়া ছিল।
শেখ মুজিবের সামনে তখন তাই এসে পড়ল এক অবিশ্বাস্য কঠিন দায়িত্ব। এক দিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিকাঠামোর পুনর্নির্মাণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আবার নতুন করে গড়ে তোলা, শহিদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন, যুদ্ধাহত ও নির্যাতিত নারীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, বিধবা-এতিমদের দেখভাল, সব নিয়ে নতুন বাংলাদেশকে একটা স্বনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা, এবং অন্য দিকে ওই সব অপশক্তির মোকাবিলা করা— কাজটা অসম্ভব রকমের কঠিন হয়ে ওঠে নতুন বাংলাদেশের জাতির পিতার জন্য।
দেশের অর্থনীতি তখন কেমন? যুদ্ধ চলাকালীন কৃষকেরা খেতে ফসল ফলাতে পারেননি। গুদামে যেটুকু খাদ্যশস্য মজুত ছিল, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী তা পুড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। ব্যাঙ্কে কোনও কারেন্সি নোট ছিল না। প্রায় শূন্য হাতে এই কঠিন কাজে এগোতে হয়েছিল তাঁকে, দেশ গড়ার কাজে। বন্ধুপ্রতিম দেশগুলি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সে দিন। আর দেশের মধ্যে— আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মুক্তিকামী মানুষেরা কোমর বেঁধে নেমে পড়েন দেশ তৈরিতে। ফল? সাড়ে তিন বছরের মধ্যে যেন মরুভূমিতে ফুল ফুটল, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নতুন রূপ পেল। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করতে এক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন তিনি: ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করার জন্য ১৯টি জেলার মহকুমাগুলিকে জেলায় রূপান্তরিত করে ৬০টি জেলা গঠন করেন। জেলা গভর্নর নিয়োগ করেন, তাঁদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেন, প্রতি জেলার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনায় নিজে নির্দেশনা দেন। জনগণের ভোটের অধিকার সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ করেন। ঠিক করেন যে, যাঁরা প্রার্থী হবেন, তাঁদের নিজেদের কোনও অর্থ ব্যয় করতে হবে না। প্রার্থীদের রাষ্ট্র অর্থ দেবে পুস্তিকা ছাপার জন্য, বা ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাওয়ার জন্য। ভোটের মালিক জনগণ। সুতরাং তার সুরক্ষার ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করার ব্যবস্থাই ছিল এর লক্ষ্য। যেন অর্থ ও অস্ত্র নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি না হয়ে ওঠে, এই চেষ্টাই করতে চেয়েছিলেন তিনি। যে কোনও সৎ, দেশপ্রেমিক মানুষ যেন নির্বাচিত হয়ে দেশ গড়ার কাজে অংশ নিতে পারেন, এটাই তিনি চাইতেন।
অচিরেই দেখা যায়, দেশে আর্থিক বৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে। স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদাও পেয়ে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু এর পরই বাধা আসতে শুরু করে একের পর এক। শুরু হয় বিশ্বব্যাপী মন্দা, তার আঘাত এসে পড়ে বাংলাদেশেও। এই সুযোগে স্বাধীনতাবিরোধী কিছু সরকারি কর্মচারী ও লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতার শত্রুরা তৎপর হয়ে ওঠে। নির্বাচিত সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের নেতাকর্মীদের নির্বিচারে হত্যা করে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তি যোদ্ধা শেখ কামালকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হত্যা করা হয়। চলতে থাকে থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন ধরানো। প্রকাশ্যেই সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তারা। খাদ্য-জাহাজ ফিরিয়ে দিয়ে দুর্ভিক্ষ-পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে অনেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন।
আর শেষ পর্যন্ত, ১৯৭৫ সালে ১৫ অগস্ট, আসে সেই চরম আঘাত— যে দিন শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন ঘাতকের অস্ত্রে। নিজের বাড়ির সিঁড়ির উপর গড়িয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, এক দরিদ্র দেশের দুঃখী মানুষের কান্ডারি।
প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ