ঐতিহাসিক: কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে নেহরুর ভাষণ। মধ্যরাত, ১৪ অগস্ট ১৯৪৭
জার্মান দার্শনিক হানা আরেন্ট এক বার খানিকটা রাগের ঝোঁকেই লিখেছিলেন— সংবিধান-রচয়িতারা হলেন রাষ্ট্র নামক একটি বাড়ির বাস্তুকার, যে বাড়িতে দেশের মানুষ থাকতে বাধ্য হন। বাড়ির বাসিন্দাদের নকশা নির্মাণে যতটুকু ভূমিকা থাকে, সংবিধান রচনায় দেশের মানুষের ভূমিকা ঠিক ততটাই, অর্থাৎ একেবারেই নগণ্য। আরেন্টের মন্তব্য ষাটের দশকের, স্তালিন-উত্তর সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি বীতশ্রদ্ধ শ্লেষ। কিন্তু ভারতবর্ষের সত্তরতম প্রজাতন্ত্র দিবসের মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের কাছে প্রশ্নটা খুবই প্রাসঙ্গিক: আমাদের সংবিধানের সঙ্গে দেশের মানুষের সম্বন্ধটা ঠিক কেমন?
ইতিহাসবিদ রোহিত দে তাঁর আ পিপলস কনস্টিটিউশন গ্রন্থে এই প্রশ্নটির একটি সুচিন্তিত, গবেষণালব্ধ উত্তর দিয়েছেন। পঞ্চাশের দশকে সুপ্রিম কোর্টে ওঠা চারটি মামলা খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করে রোহিত দেখিয়েছেন কী ভাবে সংবিধান প্রণয়নের বছর কয়েকের মধ্যেই ভারতের সমাজের নানা প্রান্তের মানুষ— শুঁড়ি, মদের খদ্দের, কাপড়ের ব্যবসাদার, কসাই, যৌনকর্মী— সরকারের বিরুদ্ধে লড়ে নিজেদের জীবন ও জীবিকার সাংবিধানিক অধিকার আদায় করেন। সুপ্রিম কোর্টের মহাফেজখানায় রক্ষিত এই সব ভুলে-যাওয়া মামলার দলিল-দস্তাবেজ বিশ্লেষণ করে লেখক সদ্য-স্বাধীন ভারতরাষ্ট্রের একটি চমৎকার সামাজিক ইতিহাস রচনা করেছেন। সংবিধান রচয়িতাদের যদি একটি গৃহের বাস্তুকার হিসেবেই ভাবি, তবে এই বইটি দেখায় কী ভাবে সেই সদ্যোজাত, কাঁচা ভারতরাষ্ট্রের নবীন নাগরিক নিজেদের মৌলিক অধিকার বুঝে, আইন-আদালতকে ব্যবহার করে সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করে, সেই গৃহটিকে বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন।
মামলা চারটি লেখক বেছেছেন নিপুণ হাতে: বম্বেতে মদের উপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে পার্সি মদবিক্রেতা-মদ্যপিপাসুদের মামলা; রেশন করে কাপড় বেচাকেনা সীমাবদ্ধ করার বিপক্ষে মাড়োয়ারি বাগলা ব্যবসায়ীদের প্রতিবাদ; উত্তরপ্রদেশে গোহত্যা-নিষেধের বিরোধী মুসলমান কুরেশি কশাইদের মোকদ্দমা; বেশ্যাবৃত্তি-বিরোধী আইন (সিটা)-র বিরুদ্ধে ইলাহাবাদের যৌনকর্মী হুসনা বাইয়ের আবেদন। প্রতিটি মামলাই পঞ্চাশের দশকে কংগ্রেসি সরকারের তৈরি আইনের বিরুদ্ধে পার্সি-হিন্দু-মুসলমান, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের সাংবিধানিক প্রতিবাদ। লক্ষণীয়, এখানে শুঁড়ি-দোকানদার-কসাই-যৌনকর্মী সকলের মামলাই আদতে জীবিকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লড়াই। আইনের ভাষায় মামলাগুলি রিট পিটিশন: আদালতের সরকারকে আদেশ করার সাংবিধানিক অধিকার। বইটির মূল বক্তব্য হল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাস্তার রাজনীতি-প্রতিবাদের সঙ্গে আইনি লড়াই জুড়ে গিয়েছিল সেই পঞ্চাশের দশকেই; এই লড়াইয়ের ঐতিহ্যই সত্তরের দশক থেকে আজ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলার ঢল নামিয়েছে।
আ পিপলস কনস্টিটিউশন/ দি এভরিডে লাইফ অব ল’ ইন দি ইন্ডিয়ান রিপাবলিক
রোহিত দে
৬৯৯.০০, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস
শুঁড়ি-কসাইয়ের ছোট ছোট লড়াইগুলিই গড়িয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত, এই পড়েই বিস্ময় জাগে। রোহিত ইচ্ছে করেই ভারতের সাংবিধানিক ইতিহাসের তথাকথিত মাইলস্টোন মামলাগুলি (যথা ১৯৬৭-র গোলোকনাথ মামলা বা ১৯৭৩-এর কেশবানন্দ ভারতী মামলা) না বেছে এই ছোট ছোট, সাধারণ মানুষের সংগ্রামগুলি বিশ্লেষণ করেছেন। এখানে ফরিয়াদি-বাদী পক্ষ অচেনা, পরিশেষে বিরাট আইনি জয় বা তেমন কোনও যুগান্তকারী রায়ও নেই— যে আইনের বিরুদ্ধে মামলা তা বেশিরভাগই পরে ঝরে পড়েছে কালের নিয়মেই। তবু এই বইয়ে উঠে এসেছে আইন ও ভারতীয় জীবনযাত্রার সম্পর্কের এই নিখুঁত সমাজচিত্র।
তাই রোহিতের গবেষণা পদ্ধতি ও লিখনশৈলী কুর্নিশের যোগ্য। দেশে ক্রমবর্ধমান উকিল-আইনজ্ঞের দৌলতে সংবিধান বা সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসের অভাব নেই, তবে তার বেশিরভাগটাই জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, হয় দেশের বিচারব্যবস্থার অন্ধ গুণগান, নয় অম্বেডকর প্রভৃতি সংবিধান রচয়িতা-বিচারকদের স্তুতি। ষাটের দশকে গ্রানভিল অস্টিন বা জর্জ গাডবোয়ার মতো বিদেশি পথিকৃৎরাও ভারতের বিচারশালা-সংবিধানসভার সীমিত পরিসর থেকে বেরোতে পারেননি, ২০১৮য় প্রকাশিত বিচারপতি চন্দ্রচূড়-পুত্র অভিনব চন্দ্রচূড়ের সুপ্রিম হুইসপার্স-ও সেই একই বিচারপতিদের গালগল্প। সেই বদ্ধ আইনকক্ষে রোহিত যেন একটি জানালা খুলে দিয়েছেন। তাঁর বইয়ের চরিত্ররা দোষে-গুণে খেটে খাওয়া মানুষ: কেউ তাড়ি খেতে ভালবাসে, কেউ মুনাফা লুটতে চায়, কেউ দারিদ্র্যের তাড়নায় যৌনকর্মী হতে বাধ্য হয়। কেবল মামলার রেকর্ডে থেমে না থেকে লেখক বিশ্লেষণ করেছেন খবরের কাগজ, ব্যঙ্গচিত্র, রাজনৈতিক পুস্তিকা, বিজ্ঞাপন ও সরকারি ফিল্ম। লেখনীর গুণে ও গবেষণার মানে এই বই যে ভারতের আইন-ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
ইতিহাসচর্চার একটি প্রধান লক্ষ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তন ও ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করা। সেখানে রোহিতের বক্তব্য স্পষ্ট: স্বাধীনতার পর ভারতীয় সংবিধান এই দেশের প্রজাতন্ত্রের দৈনন্দিন জীবন গভীর ভাবে পরিবর্তন করে, আর সেই পরিবর্তন আসে বাগলা-কুরেশি- হুসনা বাঈ প্রভৃতি সাধারণ মানুষদের হাত ধরে। এখানেই একটি প্রশ্ন ওঠে। যে সংবিধানের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ব্রিটিশ শাসকের ১৯৩৫-এর গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া আইন থেকে আক্ষরিক নকল, তা স্বাধীন দেশের জনজীবনে ঠিক কতটা মৌলিক পরিবর্তন আনতে পেরেছিল? ভারতের সংবিধানের এই বিরাট খামতি— ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা— নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন স্বয়ং অম্বেডকর; পরবর্তী কালে আয়েশা জালাল ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ইতিহাসবিদেরা বার বার বলেছেন, ব্রিটিশ ভারত ও স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র-কাঠামো ভয়ঙ্কর রকম এক, এবং সেই দায় মূলত সংবিধানের। এই প্রশ্নটি লেখক এক রকম এড়িয়ে গিয়েছেন, কেবল ভূমিকায় দু’পাতা জুড়ে এই জাতীয় সমালোচনাকে সংবিধানের বিভ্রমাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি বলে।
বিভ্রমের ফাঁদ পাতা ভুবনে। এই সমস্যাটি এড়িয়ে গেলে বইটির শিরোনাম ও মূল বক্তব্য খানিকটা প্রশ্নের মুখে তো পড়েই, আজকের আমাদের সংবিধান নিয়ে আশা-ভরসাতেও খানিকটা ধন্দের ছায়া পড়ে। রোহিত যদিও বার বার বলেছেন যে তাঁর দেখা চারটি মামলায় সংবিধান রাস্তার রাজনীতিকে সমর্থন জুগিয়েছে, এও ততোধিক সত্যি যে সংবিধানের জোরেই রাষ্ট্রযন্ত্র এমন বহু জনআন্দোলনকে পাশবিক শক্তি দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এই সংবিধানের দৌলতে ঔপনিবেশিক শাসকের মতো ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকার ফলেই রাষ্ট্র যা খুশি তাই করেছে; নির্বাচিত রাজ্য সরকার ফেলা, জরুরি অবস্থা জারি, মণিপুর-কাশ্মীরে সামরিক শাসন— সব কিছুরই সাংবিধানিক অনুমোদন আছে। এই সব দৃষ্টান্তের সঙ্গে লেখকের দেখা মামলাগুলির সম্বন্ধ ক্ষীণ হতে পারে, কিন্তু যে সংবিধান এত অন্যায় সহে, তাকে কি ঠিক জনগণের সংবিধান (পিপলস কনস্টিটিউশন) বলা যায়?
গত কয়েক সপ্তাহে সংবিধান নিয়ে আমাদের আবেগ তুঙ্গে; কলকাতার মিছিলে দেখেছি নাগরিকত্ব আইন বিরোধী মিছিলে সংবিধানের প্রস্তাবনা আবৃত্তি হচ্ছে, দিল্লির ছাত্রনেত্রী জখম হয়েও বলেছেন যে লাঠির জবাব তিনি সংবিধান দিয়েই দেবেন। এই জাতীয় আবেগ রোহিতের বক্তব্যকে নিশ্চয় আরও মান্যতা দেয়। তবে অযথা আবেগ নির্মোহ বিশ্লেষণকে গ্রাস করলে আমাদেরই ক্ষতি। আমাদের সংবিধান যে জটিল, বহু মাত্রায় ঔপনিবেশিক, এবং নানা অংশে পরস্পরবিরোধী, এই সত্যটি স্বীকার করাই মঙ্গল। এই সংবিধান সংহত, সঙ্ঘবদ্ধ রাজনীতির বিকল্প নয়। রাষ্ট্রের হাতে ক্ষমতা যত দিন কেন্দ্রীভূত, তত দিন কেবল সংবিধানের মন্ত্রোচ্চারণ করে রাষ্ট্রের হাত থেকে আমরা বাঁচতে পারব না। সত্তর বছরে সব বাড়িতেই ফাটল ধরে, আমাদের সংবিধান-সৃষ্ট গৃহেরও বহু ঘর আর থাকার মতো নেই। কেবল বাস্তুনকশায় ত্রুটির দোহাই না দিয়ে আগাছা মুড়িয়ে, রং করে এই ঘরগুলো আবার আমাদেরই নতুন করে সাজাতে হবে।