সহনশীলতার ধারণা ব্যাখ্যায় দেশভাগের ঐতিহাসিক মুহূর্তের প্রেক্ষিতটি গুরুত্ব পেয়েছে।
ইন্টারোগেটিং ইনটলারেন্স
সম্পাদনা: ইন্দ্রাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও সন্দীপন সেন
প্রকাশনা: স্বামী শাস্ত্রজ্ঞানানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির, বেলুড় মঠ, ২০১৭ (প্রথম সংস্করণ), ২০০ টাকা
বিশিষ্ট দার্শনিক কার্ল পপার উন্মুক্ত সমাজের আলোচনায় ‘অসহিষ্ণুতার কূটাভাস’ ধারণাটি এনে গণতন্ত্রের একটি অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জের উৎস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। সহনশীল সমাজ তৈরি ও রক্ষা করতে ‘অসহিষ্ণুতার প্রতি অসহিষ্ণু’ থাকাই তাঁর মতে প্রয়োজনীয় নীতি হওয়া উচিত। ক্ষণিক প্রশ্রয়ে না হলে অসহিষ্ণুতা সমাজের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠতে পারে। অত্যধিক সহিষ্ণুতা তাই তাঁর ধারণায় এক অর্থে আত্ম-বিনাশকারী। ফ্যাসিবাদী শাসক, অতি রক্ষণশীল রাজনৈতিক সমাজ কী ভাবে একের পর এক দেশে মুক্ত চিন্তা, বাক্স্বাধীনতা, যুক্তিবাদী মনন, বিশ্বাসের অধিকারের উপর আঘাত হানছে— তার প্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের পরিবেশ বজায় রাখতে পপারের এই উচ্চারণ বর্তমান মুহূর্তে বারে বারে ধ্বনিত হয়ে চলেছে।
অন্য দিকে, ন্যায় তত্ত্বের প্রবক্তা জন রলস গণতান্ত্রিক সমাজে এক বিস্তৃত সহনশীলতার নীতির উপর জোর দিয়েছিলেন যা, এমনকি বিধ্বংসী ওকালতিকেও অধিকারের মর্যাদা দেবে। তাঁর কাছে ‘অসহিষ্ণুতার প্রতি অসহিষ্ণু’ হওয়া একান্তই আত্ম-সংরক্ষণের পথ, চরম সাংবিধানিক সঙ্কটের সময়েই যার ব্যবহার চলতে পারে। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার আবহে উদ্বিগ্ন বিদ্বজ্জন সমাজ সহনশীল সমাজের ধারণাকে আরও নিবিড় ভাবে অনুসন্ধান করার প্রয়োজন অনুভব করছেন।
এই ভাবনা থেকেই বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রয়াস ‘ইন্টারোগেটিং ইনটলারেন্স’ শীর্ষক ঊনিশটি প্রবন্ধের সংকলনটি। প্রথম অংশের প্রবন্ধকারদের আলোচনায় সামগ্রিক ভাবে উঠে এসেছে যে, সহিষ্ণুতা/ অসহিষ্ণুতার বিতর্কটি কোনও বিমূর্ত প্রেক্ষিতে বিচার করা সম্ভব নয়, বরং এটিকে সামাজিক প্রেক্ষিতে দেখতে হবে।
মিরাতুন নাহারের মতে, বস্তুগত জীবনের নানা হাতছানি, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধের পরিবর্তন অসহিষ্ণু সামাজিক মনের জন্ম দিচ্ছে।
সুরজিৎ সি মুখোপাধ্যায় প্রতি দিনের সাংস্কৃতিক প্রতর্কে, শিক্ষাদানের ঐতিহ্যে কী ভাবে এই অসহিষ্ণুতা জারিত হয় তা দেখিয়েছেন।
সমাজতাত্ত্বিক প্রশান্ত রায়ের মতে, অসহিষ্ণুতার বাস প্রাত্যহিক জীবনযাপনে। আর এর উৎস নিহিত অসাম্যের কাঠামোগুলিতে। তাই কেবলমাত্র নৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে এর অবসান সম্ভব নয়, প্রয়োজন সুবিচারের নীতি প্রতিষ্ঠা করা।
মার্ক্সবাদী ইতিহাসের আলোকে অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্ত এই বিতর্কটিকে একটি অন্য মাত্রায় ব্যাখ্যা করেছেন। বিশেষত অক্টোবর বিপ্লব ও পরবর্তী সোভিয়েত সমাজের প্রেক্ষাপটে।
বর্তমান সমাজে গণতন্ত্র, সহনশীল সমাজের আলোচনা গণমাধ্যমের ভূমিকার উল্লেখ ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। কারণ মিডিয়া তথ্যের উৎস। অনেকাংশে বিতর্কের নির্মাণকারী। সে প্রসঙ্গও রয়েছে এি সংকলনের প্রথম ভাগে।
সংকলনটির দ্বিতীয় ভাগে সহনশীলতার ধারণা ব্যাখ্যায় রামমোহন, গাঁধীর চিন্তার পাশাপাশি দেশভাগের ঐতিহাসিক মুহূর্তের প্রেক্ষিতটি গুরুত্ব পেয়েছে। একটি বহুত্ববাদী জাতি-সমাজ গঠনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যে ধরনের টানাপড়েন চলতে থাকে তাতে অসহিষ্ণুতার নানা ক্ষেত্র নির্মিত হয়। গণতন্ত্রের বিকাশও সেই নিরন্তর সংগ্রামকে বিভিন্ন আকার দেয়। কখনও লিঙ্গ চেতনার লড়াই, সম্প্রদায়গত ইতিহাস রচনার দাবি, আবার কখনও শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতার পরিসরে দলগত রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যে থেকে এই বিতর্ক নতুন নতুন মাত্রা পায়।
এ সব বিষয় উঠে এসেছে সংকলনটির বিভিন্ন প্রবন্ধে। ভারতীয় সমাজে সহনশীলতার প্রতর্ক নির্মাণে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক উপাদানের পাশাপাশি ধর্মীয়-সাংষ্কৃতিক নানা আন্দোলনের প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। এর মধ্যে রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ সূত্রটি উদারবাদী ন্যায় সমাজ ধারণায় একটি অমূল্য সংযোজন হিসাবে দেখা যেতে পারে। বর্তমান ভারতে শাসক-শাসিতের মধ্যে এক চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের আবহে তাঁর দর্শন অনুসারী সংগঠনের বিদ্যায়তনের পক্ষ থেকে এই বিতর্ককে ফিরে দেখা কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি জরুরি প্রয়াস।