ফেলুদা বললেই বাঙালির চোখে যেমন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চেহারা ভাসে, জটায়ু শুনলেই যেমন মনে পড়ে নির্বিকল্প সন্তোষ দত্ত, তোপসে নামটার সঙ্গে ঠিক তেমন ভাবে জড়িয়ে আছেন সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ, এই দু’টি ছবিতে তাঁর অভিজ্ঞতার গল্প শুনিয়েছেন ‘প্রথম তোপসে’। প্রথম গল্পটাই কেলেঙ্কারির— পাঠ ভবন স্কুলের শিক্ষক পার্থ বসুর সঙ্গে সিদ্ধার্থ গিয়েছেন বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই প্রবাদপ্রতিম ফ্ল্যাটে, কিন্তু তখনও ফেলুদা কে, সে খবর জানা-ই ছিল না তাঁর। সত্যজিৎ রায়ই তাঁকে সোনার কেল্লা বইটি উপহার দেন পড়ে দেখার জন্য। রাজস্থান, উট আর রিভলভার, এই সব লোভ দেখিয়ে রাজি করান সিনেমায় নামতে। তার পর বিস্তর মজা। কোনও শট অপছন্দ হলেও সত্যজিৎ বলতেন, ফ্যান্টাস্টিক হয়েছে, তবে সেফটির জন্য আর একটা নিয়ে নিই? আর শট পছন্দ হলেই, ‘ব্রিলিয়ান্ট’, ‘এক্সেলেন্ট’! অভিনেতাদের মনোবল বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এমন টনিক আর হয়? সব অভিনেতার এক সঙ্গে থাকা, শুটিংয়ের ফাঁকে এক সঙ্গে খাওয়া— একটা জমজমাট পিকনিকের মেজাজে কী ভাবে তৈরি হয়ে উঠল সিনেমাটি, সে গল্পে বাঙালির উৎসাহ থাকবেই।
ফেলুদার প্রথম তোপসে
সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়
৩২৫.০০
পত্রভারতী
সিদ্ধার্থ শুটিংয়ের যে সব গল্প বলেছেন, তার কয়েকটা বাঙালি পাঠকের চেনা, একেই বলে শুটিং-এ সে সব কাহিনি নিজেই লিখেছিলেন সত্যজিৎ। তার বাইরেও রয়েছে দারুণ সব গল্প। মন্দার বোস, মানে কামু মুখোপাধ্যায় নাকি ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে সবাইকে বলে দিয়েছিলেন, যে যেটা খাবে না, সেটা যেন কামুর রেখে দেওয়া বাড়তি প্লেটে তুলে রাখে। কামুই খেতেন সে সব। তার পরও, জ্যাকেটের ভিতরে কাঁচা ডিম লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন শুটিংয়ে— যে দিন উটের ল্যাগবেগে হাঁটা দেখানোর দৃশ্য শুট করা হল, সে দিন। পেটে সত্যজিতের ঘুষি খেয়ে ডিম ফেটে চরম বিভ্রাট! আর এক দিন, চলন্ত গাড়িতে ‘উট কি কাঁটা বেছে খায়?’ সংলাপটির পর যে-ই না গাড়ি থামল, সত্যজিৎ ক্যামেরা থেকে চোখ সরালেন, অমনি পিছন থেকে এসে সে গাড়িতে ধাক্কা দিল এক লরি। চোখ সরাতে এক সেকেন্ড দেরি হলে কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড হত, ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়।
অপারেশন গুড উইল
দীপাঞ্জন চক্রবর্তী
২৫০.০০
বসাক বুক স্টোর
রয়েছে কিছু মানবিক মুহূর্তের কথাও। রাজস্থানের হাড়-কাঁপানো শীতে যখন ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াল, তখন কামরায় খাওয়াদাওয়া চলছিল। এমন সময় জানলার কাচে টোকা দিয়ে খাবার ভিক্ষা চাইলেন এক দুঃস্থ বৃদ্ধ। নিজের খাবারটা প্যাকেটে মোড়া অবস্থাতেই তাঁকে দিয়ে দিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এমন আরও অজস্র না-জানা কাহিনি বৈঠকি গল্পের মেজাজে শুনিয়েছেন সিদ্ধার্থ। গত পয়লা মে সোনার কেল্লার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ছবিটির যে বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছিল, তাতে বিভিন্ন দৃশ্যে দর্শকের স্বতঃস্ফূর্ত হাততালি জানিয়েছিল, এ ছবি কখনও পুরনো হওয়ার নয়। তোপসের স্মৃতিচারণও ঠিক সে কথাই বলল।
পটনা থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে এক সংস্থার প্লান্টে হামলা চালাল শ’খানেক সশস্ত্র জনতা, আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল কারখানায়। তার চেয়েও উদ্বেগের কথা, কারখানা থেকে তিন সাধারণ কর্মী, আর তিন নিরাপত্তারক্ষীকে তুলে নিয়ে গেল তারা, পণবন্দি হিসাবে। কয়েক কোটি টাকা মুক্তিপণের দাবি। খানিক খোঁজখবর নিতেই বোঝা গেল, এর পিছনে মাওবাদীদের হাত রয়েছে। তাদের কবল থেকে উদ্ধার করে আনতে হবে সেই ছ’জন কর্মীকে। মুক্তিপণ দেওয়া যাবে না, কারণ এক বার সে টাকা দেওয়া হলে পথ খুলে দেওয়া হবে পরের অজস্র অপহরণ আর মুক্তিপণের দাবির— মাওবাদীদের অর্থোপার্জনের সহজতম পথ হয়ে দাঁড়াবে এটাই। শেষ পর্যন্ত কী ভাবে এই ছ’জনকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেন এনএসজি-র ভূতপূর্ব কম্যান্ডো, এবং এই ঘটনার সময় সেই কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান দীপাঞ্জন চক্রবর্তী, একেবারে রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারের ভঙ্গিতেই সেই গল্প লিখেছেন তিনি। সে কাহিনির অন্যতম চরিত্র এক সময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাওবাদী কম্যান্ডার কিসেনজি। তিনি সাহায্য করেছেন দীপাঞ্জনকে, কিন্তু তাঁরও শর্ত ছিল— পুলিশ যেন কোনও ভাবেই কোনও অপারেশন না করে। সেই শর্ত মেনে, প্রতি মুহূর্তে কয়েক জোড়া অদৃশ্য চোখের নজরদারিতে থাকতে থাকতে শেষ অবধি বিহারের ভয়ঙ্কর জায়গা থেকে উদ্ধার করা গেল ছ’জনকে। তার জন্য প্রয়োজন হল টেলিফোন সংস্থার সাহায্য; পুলিশকে অন্তত সাময়িক ভাবে নিষ্ক্রিয় রাখার জন্য গোপন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ; সাংবাদিকের যোগাযোগ। এবং, কাহিনির পরতে পরতে উন্মোচিত হল এক অসহায়তার আখ্যানও— কী ভাবে পুলিশ আর মাওবাদীদের মধ্যে পিষ্ট হতেই থাকেন হতদরিদ্র মানুষ, কী ভাবে তাঁরা ব্যবহৃত হতে থাকেন দু’পক্ষের হাতেই। টান-টান বইটিতে কিছু মুদ্রণপ্রমাদ ও বানান ভুল থাকায় মাঝেমধ্যে ছন্দপতন হয়। আর একটু যত্ন প্রত্যাশিত ছিল।