—প্রতীকী চিত্র।
পাঁচ বছর পেরিয়ে গেল, মৃণাল সেন নেই। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুর পর বীরভূমের দু’টি জনজাতি গ্রামের মানুষ খবর পেয়ে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। ওই বল্লভপুরডাঙা ও সরকারডাঙা গ্রামের মানুষের জন্য তিনি বিদ্যুতের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন সাংসদ থাকাকালীন। স্থানীয় উন্নয়ন তহবিল থেকে শুধু অর্থ বরাদ্দের সুপারিশই করতেন না, প্রকল্প রূপায়ণের ব্যাপারে নিয়মিত তদারকিও করতেন। গ্রামবাসীদের কাছে তিনি আলোর মানুষ হলেও তাঁর ছবির কথা শোনেননি তাঁরা। তাঁদের ইতিহাস নিয়েই সত্তর দশকে তাঁদের গ্রাম থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে শুটিং হওয়া মৃণালবাবুর মৃগয়া ছবির কথা ছিল তাঁদের অজানা। আল-আমীন মিশনের দুঃস্থ অনাথ মেধাবী পড়ুয়াদের জন্য রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে তাঁর সাংসদ তহবিল থেকে তুলে দিতে পেরেছিলেন ৮৮ লক্ষ টাকা।
এমন আরও অজস্র উদাহরণ মৃণালবাবুর সাংসদ-জীবন থেকে তুলে এনে সোমেশ্বর ভৌমিক তাঁর বইটির দীর্ঘ এক আলোচনায় জানিয়েছেন, যে মানুষদের মৃণালবাবু তাঁর সিনেমার সূত্রে ছুঁতে পারেননি, তাঁদেরকেই ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিলেন নব্বই দশকের শেষে এসে। এ দেশের যে মানুষের কাছে সংসদ আলোকবর্ষ দূরের পৃথিবী, তাঁদের কাছে তিনি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন আলোকপ্রাপ্তির রসদ। এক দিকে তখন উপলব্ধি করছেন নিজের সাংসদ-ভূমিকার অসারতা, অন্য দিকে প্রাণপণে চেষ্টা করছেন সাংসদ তহবিলের সূত্রে জনজীবনের সঙ্গে সংযোগের।
মৃণাল সেন: একটি ব্যক্তিগত পাঠ
সোমেশ্বর ভৌমিক
৪২৫.০০
ঋত প্রকাশন
এই অভিজ্ঞতা থেকেই নতুন শতকের শুরুতে তৈরি করেন তিনি শেষ ছবি আমার ভুবন। ছবিটির “আপাত-সারল্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে সেই দ্বান্দ্বিকতার বয়ান।”— মনে হয়েছে সোমেশ্বরের, সংসদ ভবন ও আমার ভুবন, এ দুইয়ের সংযোগে তৈরি হয়েছে এক আশ্চর্য ভুবন, “মৃণাল সেন-এর চলচ্চিত্রমালায় পশ্চিমী সংস্কৃতির লব্জে যাকে বলা হয় ‘রাজহাঁসের গান’ বা swan song অর্থাৎ অন্তিম সংগীত।”
দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায় সংসদ-প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে মৃণাল সেন বলেন, “এ-ব্যাপারটা একেবারেই আমার প্রকৃতির সঙ্গে যায় না।” তাঁর সেই বিস্তারিত সরস বয়ানের মধ্যে একই সঙ্গে লুকিয়ে থাকে কৌতুক এবং শিল্পে কাঙ্ক্ষিত অন্তর্ঘাত। এক বার রাজ্যসভার এক সদস্য তাঁকে ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলেন: আপনি তো মশাই কাশ্মীরের হানাদারদের মতো মাঝে মাঝে আসেন আর উধাও হয়ে যান। তৎক্ষণাৎ তাঁর উত্তর, “দেখুন লড়াকু হানাদারদের দিয়েই বিপ্লব হয়। অনেক বছর আগে সিনেমা-জগতে এই রকম বাইরে থেকে হানা দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় আর তাঁর অনুগামীরা।”
ছবি তৈরির সময় মৃণাল সেন প্লট বা ঘটনার উপর তত গুরুত্ব না দিয়ে চরিত্রগুলির অনুভূতির উপর জোর দিয়ে তাঁর ছবিটিকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতেন। তিনি যখন ছবি-করা শুরু করেন, তখন পূর্বজরা তাঁকে শেখাতেন— সিনেমায় প্রচুর ঘটনা থাকা উচিত, একটা ঘটনা থেকে আর একটা, তার থেকে আর একটা, এই ভাবে চিত্রনাট্য হয়ে উঠবে নানা ঘটনায় গাঁথা একটি মালা। কিন্তু মৃণালবাবু সেই তত্ত্বে বিশ্বাস রাখতে পারেননি। দীপঙ্করের সঙ্গে এ সব কথাবার্তার জেরে তাঁর অমোঘ মন্তব্য: “সিনেমার ভাষাও বড়ো পুরোনো হয়ে গিয়েছে, সেটাও বদলানো উচিত।”
আলাপে সংলাপে মৃণাল সেন
দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায়
৩২৫.০০
ঋত প্রকাশন
ধরাবাঁধা ছাঁচে-আঁটা জীবনের গল্প বলতে চাননি বলেই বোধ হয় কখনও ‘ট্র্যাডিশনালিস্ট’ হননি। নিছক নান্দনিক নিরীক্ষার জন্যে নয়, নতুন কথা বা নতুন বিষয় বিধৃত করার জন্যেই ফিল্মের ফর্ম বা টেকনিক নিয়ে অবিরত ভাঙচুর চালিয়ে গিয়েছেন। এ রকম চাপেই তো বার বার বদলে গিয়েছে যাবতীয় আর্ট ফর্মের ব্যাকরণ, তবে কেন সে পরিবর্তন ফিল্মের আয়ত্তাধীন হবে না, বা এ ভাবেই কোনও স্বাবলম্বন খুঁজে নেবে না ফিল্ম— এ প্রশ্নের উত্তর নিজের ছবি তৈরির ভিতর দিয়েই খুঁজে গিয়েছেন মৃণাল সেন, আজীবন।
আঙ্গিক নিয়ে এই নিরীক্ষা মৃণালবাবুর হাতে কখনও কোনও দিনই অহেতুকের খেলা হয়ে ওঠেনি। চার পাশের মতিচ্ছন্ন সময়কে কাটাছেঁড়ার তাগিদে, সমাজ এবং মানুষের গভীর ব্যবচ্ছেদকে তুলে ধরার তাগিদে তিনি বার বার ব্যবহার করেন এই প্রকরণগত কৌশল। পাশাপাশি কত কম খরচে কত ভাল ছবি করা যায়, সেটাও নিজের ছবিতে করে দেখাতেন মৃণাল সেন। গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে নতুন এই শতকের গোড়া পর্যন্ত নিজের সৃষ্টিশীলতায় এ ভাবেই রত ছিলেন তিনি। তাঁর কর্মকাণ্ড ও ভাবনার জগৎ নিয়ে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ যে ক’জন নিরন্তর চর্চা করে গিয়েছেন, সোমেশ্বর আর দীপঙ্কর তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
মৃণালবাবুর ফিল্মের নিজস্ব ঘরানা নিয়ে একাধিক আলোচনা করেছেন সোমেশ্বর ভৌমিক তাঁর বইটিতে। কোনও সার্বিক মূল্যায়ন নয়, মৃণালবাবুর সঙ্গে প্রায় চার দশকব্যাপী তাঁর মোকাবিলার এক কালানুক্রমিক খতিয়ান, দর্শক পাঠক বা সাক্ষাৎকারপ্রার্থী-শ্রোতা হিসাবে। আর দীপঙ্করের সাক্ষাৎকারগ্রন্থটি মৃণালবাবুর সঙ্গে তাঁর শিল্পমন নিয়ে দীর্ঘ আলাপচারিতা— গুরুত্বপূর্ণ, মৃণাল সেনের মনোরথের ঠিকানা খুঁজে পেতে সাহায্য করবে পাঠককে।