আওয়ার ফিল্মস দেয়ার ফিল্মস সত্যজিৎ রায় ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৭৬।
একটা ছবি কী ভাবে ধ্রুপদী হয়ে ওঠে? চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনায় এ প্রশ্নটা অবিরত ঘুরেফিরে আসে, কিন্তু এর কোনও সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর হয় না। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি যে, প্রধানত তিনটি বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে কোনও ছবির ধ্রুপদী হয়ে ওঠা। প্রথমত, আপনি কখনও সে ছবি দেখে ক্লান্ত হবেন না। দ্বিতীয়ত, আপনি যখন যে ভাবেই দেখুন না কেন, প্রতি বারই মনে হবে ছবিটি সমকালীন। আর তৃতীয়ত, আপনি যত বার দেখবেন তত বারই নতুন কিছু না কিছু আবিষ্কার করবেন ছবিটির ভিতর থেকে।
কেউ যদি এই বৈশিষ্ট্যগুলি প্রয়োগ করে চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালিখির, বিশেষত সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা সংক্রান্ত লেখালিখির ক্ষেত্রে? সময়ের পরীক্ষা সেখানে হবে কী করে? সত্যজিৎ-রচিত আমার প্রিয় একটি বই নিয়ে লিখতে বসে অস্বস্তিতেই পড়েছিলাম। এত ব্যাপ্ত তাঁর লেখালিখির জগৎ, গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি গদ্য-প্রবন্ধও কম নয়, তা থেকে নিজের পছন্দটা বেছে ওঠা খুব মুশকিল। আর তাঁর এই অ-কাহিনিমূলক গদ্যগুলি, বাংলা বা ইংরেজিতে লেখা ছোট-বড় নানা আকারের, বলতে গেলে তাঁর সেরা রচনা, বিভিন্ন সময়ে যা সঙ্কলিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কোনও একটি রচনাকে বরং আমার প্রিয় হিসেবে চিহ্নিত করা অনেক বেশি সহজ।
অন্তরঙ্গ কোনও আলাপচারিতা বা আড্ডায় সত্যজিৎ সব সময়ই রীতিমতো খোলামেলা ভাবে রাজনীতি, সমাজ, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, এমনকি অধ্যাত্মবাদ নিয়েও কথা বলতেন, কিন্তু আমার যত দূর জানা আছে তিনি কখনওই এ সব বিষয়ে লিখতেন না। কেন যে লিখতেন না, আমার কাছে তা বিস্ময়ের কারণ। অথচ তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে যখন লিখতেন, নিজের ছবিই হোক বা অন্যের ছবি, খোলাখুলি মত জানাতে বা তর্ক তুলতে এতটুকু পিছপা হতেন না। সে জন্য কখনও তিনি আত্মজীবনী লেখার কথা চিন্তাই করেননি, তাঁর যাত্রাপথের কাহিনি টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে বা লুকিয়ে তাঁরই নানান রচনা, গল্প ও গদ্যে, কেউ তাঁর সমগ্রের খোঁজ করলে তাঁকে সেগুলি পড়তে হবে, বারে বারে ফিরে ফিরে পড়তে হবে।
আমি ওঁর যে বইটা ফিরে ফিরে পড়ি, তা হল আওয়ার ফিল্মস দেয়ার ফিল্মস, ১৯৭৬-এ প্রকাশিত একগুচ্ছ লেখার সঙ্কলন। খবরের কাগজ বা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বেরোনো সেই সব লেখার কোনওটি হয়তো ১৯৪৮-এও বেরিয়েছিল। বইয়ের নামটির মধ্যে অবশ্য কেউ আত্মবিরোধিতা খুঁজে পেতে পারেন, বিশেষত এই ইন্টারনেট আর ওটিটি প্ল্যাটফর্মের যুগে, কারণ ‘আওয়ার’ বলতে এখানে ভারতীয় আর ‘দেয়ার’ বলতে আলাদা কিছু, এ এখন কারও কাছে অপ্রাসঙ্গিক ও অচল মনে হতেই পারে। সারা দুনিয়ার ব্যাপারস্যাপারের সঙ্গেই আমাদের এখন অনায়াস বনিবনা, পৃথিবীর সব ছবিকেই এখন আমরা ‘আওয়ার ফিল্মস’ বলতে পারি সহজেই। তবে বইয়ের নাম নিয়ে যা-ই মনে হোক, এতে সঙ্কলিত লেখাগুলি এখনও অসম্ভব প্রাসঙ্গিক, সর্বদা তা-ই থাকবে বলেই মনে হয়।
আমি সব সময়ই হাতে গোনা কয়েক জন সমালোচক ও লেখকের উপর নির্ভর করি, যাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণে আমার আস্থা আছে। চলচ্চিত্র আস্বাদনে বা কোনও ছবির মূল্যায়নে তাঁদের ভাবনা আমার কাজে লাগে। বস্তুত খুব অল্প ফিল্মই তাদের শুদ্ধ শিল্পস্বভাব বা শিল্পভাষার গুণে আমার অনুভবে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে, সে সবের স্থান ও পরিপ্রেক্ষিত কোনও নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক পরম্পরায় সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যেটা দুর্ভাগ্যজনক, খুব অল্প সংখ্যক সমালোচকই সেই পটভূমিটিকে ঠিকমতো উপস্থাপিত করতে পারেন। আমি যখন কোনও নির্দিষ্ট ফিল্ম নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করি বা কোনও লেখা তৈরি করি, তখন সত্যজিতের রচনাসঙ্কলনটিই আমাকে চিন্তার খোরাক, মগজের পুষ্টি জোগায়।
গোটা পঁচিশেক প্রবন্ধ আছে তাঁর বইটিতে, সেগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জায়গা এটা নয়। তবে কিছু নমুনা পেশ করা যেতেই পারে। ভূমিকায় সত্যজিৎ লিখছেন: “...ইট ইজ় পসিব্ল ফর আ ফিল্ম টু ওয়ার্ক, অ্যাজ় পথের পাঁচালী ডাজ়, হোয়েনেভার ইট লিভস ইটস রিজনাল মুরিংস অ্যান্ড রাইজ়েস টু আ প্লেন অব ইউনিভার্সাল জেশ্চার্স অ্যান্ড ইউনিভার্সাল ইমোশনস।” এর পর কি আর ‘আওয়ার’ আর ‘দেয়ার ফিল্মস’-এর পার্থক্য করা চলে?
‘হোয়াট ইজ় রং উইথ ইন্ডিয়ান ফিল্মস?’ (১৯৪৮) শিরোনামের একটি লেখার শেষে লিখছেন: “দ্য র’ মেটেরিয়াল অব দ্য সিনেমা ইজ় লাইফ ইটসেল্ফ। ইট ইজ় ইনক্রেডিব্ল দ্যাট আ কান্ট্রি হুইচ হ্যাজ় ইনস্পায়ার্ড সো মাচ পেন্টিং অ্যান্ড মিউজ়িক অ্যান্ড পোয়েট্রি শুড ফেল টু মুভ দ্য ফিল্ম মেকার। হি হ্যাজ় ওনলি টু কিপ হিজ় আইজ়
ওপেন, অ্যান্ড হিজ় ইয়ার্স। লেট হিম ডু সো।” এখনকার ছবি-করিয়েরা কি চোখকান খোলা রাখেন তাঁদের চার পাশের সমাজ-রাজনীতির বাস্তবতার প্রতি?
জাপানি সিনেমা নিয়ে একটি লেখা আছে, ‘কাম উইদিন, ফায়ার উইদাউট’ (১৯৬৩)। সেখানে লিখছেন, “…ইট ইজ় ইম্পর্ট্যান্ট টু রিমেমবার দ্যাট স্লোনেস ইজ় আ রিলেটিভ থিং, ডিপেন্ডিং অন দ্য ডিগ্রি অব ইনভলভ্মেন্ট অব দ্য ভিউয়ার... উই রিয়ালি কাম ব্যাক টু দ্য কোয়েশ্চ্ন অব দ্য ট্রু কনয়জার্স রেসপন্স অ্যাজ় অপোজ়ড টু দি আনইনিশিয়েটেড লেম্যান।”
ওই লেখাটির প্রায় দু’দশকেরও পরে তিনি এক দিন আমায় সবিস্তারে বলেছিলেন, কী ভাবে তিনি তাঁর ছবিতে একাধিক বা বহু স্তর বুনে দেওয়ার চেষ্টা করেন, কাঠামোর উপরিতলে একটি কাহিনি বা আখ্যান থাকে শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত দর্শকের জন্য, আবার ওই কাহিনি-কাঠামো খুঁড়েই কোনও চলচ্চিত্রবেত্তা (অর্থাৎ, কোনও প্রকৃত চলচ্চিত্র রসিক বা বোদ্ধা) খুঁজে নিতে পারেন ভিন্ন, গভীরতর কোনও অর্থ।
ঠিক একই কারণে তাঁর এই বইটিও মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে আমার কাছে, গভীর আবেদন বয়ে আনে প্রথম প্রকাশের চার দশক পরেও। বারে বারে ফিরে ফিরে পড়ি— গভীরতর, ভিন্ন কোনও অর্থ আবিষ্কারের নেশায়।