চার ঘণ্টা— জীবনের শেষ সম্বলটুকু জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেতে এইটুকু সময়ই বোধ হয় যথেষ্ট। সম্প্রতি তপসিয়ার মজদুরপাড়া বস্তির অগ্নিকাণ্ড আরও এক বার তার প্রমাণ দিল। শহরের অন্যান্য বস্তি অঞ্চলের অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে তপসিয়াকে খুব বেশি পৃথক করা যায় না। ঘরের উনুন থেকে আগুন লাগা, শীতের শুকনো হাওয়ায় তার দ্রুত ছড়িয়ে পড়া, দাহ্যপদার্থ-ঠাসা গায়ে-লাগা শতাধিক ঘরের মুহূর্তে জ্বলে ওঠা, ঘরে মজুত সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, স্থানীয়দের প্রাথমিক ভাবে আগুন নেবানোর মরিয়া চেষ্টা— ঘটনাপরম্পরা মোটামুটি এক। অতঃপর পুড়ে যাওয়া ঘরে পড়ে থেকেছে দগ্ধ বইখাতা, পোশাক, সঞ্চিত অর্থ। পোষা মুরগিদের চোখের সামনে মরতে দেখেছেন বাসিন্দারা। এই ঘটনা যতটা মর্মান্তিক, ঠিক ততটাই উদ্বেগের।
উদ্বেগ এই কারণেই যে, গত কয়েক মাসে কলকাতায় অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যাটি লক্ষণীয় রকমের বেশি। এই বছর নভেম্বরে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে কলকাতা পুলিশ এলাকায় নথিভুক্ত অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ২৫টি। সারা বছরের হিসাব ধরলে এবং অগ্নিকাণ্ডের স্থানগুলি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বিষয়টি নিয়ে সর্ব স্তরে এখনও সচেতনতার প্রবল অভাব রয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের তালিকায় বস্তি এলাকা থেকে বহুতল, হাসপাতাল, বাজার, শপিং মল— বাদ ছিল না কিছুই। এবং অব্যবস্থার নিরিখে কোনও অঞ্চলই পিছিয়ে নেই। বস্তি এলাকায় বড় সমস্যা— সঙ্কীর্ণ পরিসরে বহু মানুষের বসবাসের বিষয়টি। ফলে, ক্ষণিকের অসাবধানতা বিরাট ক্ষতির পথ করে দেয় সহজেই। ধূপকাঠি, উনুন, মোমবাতি, মশার ধূপ থেকে লাগা আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে মূলত সহজদাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি ঘরগুলিতে। অন্য দিকে, যাতায়াতের পথ অত্যন্ত সরু হওয়ার কারণে দমকলের গাড়ি প্রবেশে অসুবিধা দেখা দেয়। পূর্ণ প্রস্তুতি-সহ কাজ শুরু করতে গিয়ে নষ্ট হয় বহু মূল্যবান সময়। কিন্তু সমস্যা শুধু বস্তি এলাকার নয়। হাসপাতাল, বড় ও পুরাতন বাজার এলাকা, এমনকি শপিং কমপ্লেক্সও অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরে দেখা যায়, অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থার নামে যা মজুত রাখা আছে, তা কাজ করে না, আপৎকালীন সিঁড়ি ভর্তি হয়ে থাকে আবর্জনায়, ঘরের ভিতরে কোনও সুরক্ষাব্যবস্থা ছাড়াই জমা থাকে দাহ্যপদার্থ। এমতাবস্থায় দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণহানি এবং অন্য ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকাও প্রশ্নাতীত নয়। প্রায়শই পুলিশ-দমকলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অগ্নিকাণ্ড রোধে শহরের বিভিন্ন স্থানে উপযুক্ত ব্যবস্থার কথা। কার্যক্ষেত্রে তার ক’টি চোখে পড়ে? যথাযথ অগ্নিসুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকলেও নির্মাণগুলিকে ছাড়পত্র দেওয়া, বড় বাজারগুলিতে পরিদর্শনের অভাব, দমকলের দেরিতে আসার অভিযোগ— এগুলিকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। যেমন উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই বস্তির জমি উদ্ধারে আগুন ‘লাগিয়ে দেওয়া’র তত্ত্বও। মনে রাখতে হবে, দরিদ্রের কাছে আগুন অভিশাপস্বরূপ। সেই অনিশ্চয়তা থেকে তাঁদের বাঁচাতে অবিলম্বে নির্বিকার মনোভাব এবং লোভ ঝেড়ে ফেলে সার্বিক পরিকল্পনার প্রয়োজন। শুধুমাত্র অন্য অস্থায়ী ঠিকানায় তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়াতেই যে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, প্রশাসনের তা বোঝার সময় এসেছে।