বিশ্বসভ্যতায় মুসলিম অবদান
খন্দকার মাহমুদুল হাসান
৩০০.০০
হরফ প্রকাশনী
অষ্টম থেকে প্রায় দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানরা দেশ জয় করে বিশ্ব জুড়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠাই করেননি; বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শনের মতো জ্ঞানচর্চায় অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিলেন। আজ বিজ্ঞানের যে প্রাপ্তিগুলোকে ইউরোপীয়দের কৃতিত্ব বলে দাবি করা হয়, তার অনেকটাই সে যুগের মুসলমানদের কীর্তি। মুসলমানের আজ যে দশা হয়েছে, তা দেখে কারও পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয় যে, মাত্র কয়েক শতকের মধ্যে মুসলমানের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে গিয়েছে বিশ্ব জুড়ে তার ক্ষুধার্ত ও ধর্মসর্বস্ব বিপুল জনসংখ্যা, অ-মুসলিম দেশে অভিবাসনের ঢল, ভয়াবহ ভ্রাতৃঘাতী খুনোখুনি। ইসলামের সোনালি দিনের কথা আজকের মুসলমানরাও কি মনে রেখেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা সম্ভবত জানি।
আব্বাসি বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, ৭৪১ থেকে ৮৬১ পর্যন্ত বিজ্ঞানচর্চাকে যে ভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়, তা আলেকজ়ান্দ্রিয়ার সংগ্রহশালার আদি যুগের পর আর দেখা যায়নি। স্পেনের কর্ডোভা-তে উমাইয়া খলিফাদের শাসনকাল (৯২৮-১০৩১) এবং সিপেন ও মরক্কোয় তৎপরবর্তী ছোট ছোট আমিরদের শাসনকালেও বিজ্ঞানকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এমনকি, মুসলিম সংস্কৃতির অবক্ষয়ের যুগেও সালাদিন, গজনির মামুদ, সমরখন্দের উলুঘ বেগ প্রমুখ উচ্চাভিলাষী শাসকেরা বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষণা করে গর্ববোধ করতেন। ইসলামি বিজ্ঞানচর্চার ধর্মনিরপেক্ষ ও বাণিজ্য-নির্ভর পটভূমিটি মধ্যযুগের খ্রিস্টান দুনিয়ায় বিজ্ঞানচর্চার পটভূমি থেকে স্বতন্ত্র, কেননা খ্রিস্টান দুনিয়ায় বিজ্ঞানচর্চা ছিল বহুলাংশে চার্চ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাসে ছিল মুসলিম মনীষীদের অগ্রণী পদচারণা। মুসলিম বিজ্ঞানীরা দিগন্ত উন্মোচনকারী আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বের চেহারাই বদলে দিয়েছেন। সে সব আবিষ্কার ও গবেষণার আধুনিকীকরণ ঘটেছে, সুফল ভোগ করছে আজকের বিশ্ববাসী। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ১৯৩২ সালে সভাপতির অভিভাষণে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় ইসলামের কীর্তি বিষয়ে বলেছিলেন, “আমাদিগকে তাঁহাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিতে হইবে এবং সেই প্রেরণা, সেই অবাধ সত্যানুসন্ধান, সেই জাতিদেশনির্বিশেষে উন্মুক্ত চিত্তে জ্ঞানাহরণ, যাহা ইসলামকে তাহার উচ্চ স্থান প্রদান করিয়াছিল, সেইভাবে আমাদিগকে বিভোর হইতে হইবে।”
এই মুহূর্তে প্রশ্ন করা প্রয়োজন, এমন ইতিহাস আমরা জানি না কেন? আমাদের ইতিহাস বইয়ে মুসলমানের এই সব উজ্জ্বল সময়ের কথা থাকে না। ইসলাম কেন তা মানুষকে জানাতে উদ্যোগী হয়নি? সে ব্যস্ত থেকেছে ইসলামের যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের পরম্পরাকে দূরে সরিয়ে সুন্নতের খাঁটি অনুসারী হয়ে উঠতে। সেই ধর্মান্ধ যুক্তিহীন অনুসরণ থেকে তার নিস্তার নেই, নানা ফেরকা-র ইসলামি সংস্কারবাদী আন্দোলনের জনপ্রিয়তা দেখে তা টের পাওয়া যায়। অতীতচারী আন্দোলনের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক নেই।
ইংরেজিতে বেশ কিছু বই থাকলেও ইসলামি স্বর্ণযুগের অর্জনগুলো নিয়ে বাংলা বই দুর্লভ। আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সৈয়দ সামসুল আলমের ইসলামি সভ্যতায় উদ্ভাবন ও আবিষ্কার এবং মিতা দাসের অন্য এক রেনেসাঁস বই দু’টি তথ্যসমৃদ্ধ। আলোচ্য বইটি তালিকায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এ বইয়ে মুসলমানদের অবদানের ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্ব পাঁচটি অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। ইসলামের উদ্ভব এবং বেড়ে ওঠা আরবে, তাই আলোচনার অভিনিবেশ আরবকেন্দ্রিক। পূর্ব এশিয়া বা আফ্রিকায় ইসলামের প্রসারের ফলে সভ্যতার কোথায় কতটুকু উৎকর্ষ সাধন হয়েছে, তা আলোচনায় ঠাঁই পায়নি। ইসলামি সভ্যতার পতনের কারণগুলির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। ইতিহাস ও পুরাকীর্তির এই গবেষক-লেখক মুসলিম স্থাপত্য নিয়ে অধ্যায়টি সাজিয়েছেন বিশেষ যত্নে।