book review

Book Review: নিজের অধিকারের সীমা জানি কি

অবমাননা আইনের অস্তিত্বের আসল কারণ হল ‘বিচারপতিদের ঘিরে থাকা গৌরবের ঔজ্জ্বল্য অটুট রাখা’।

Advertisement

শমীক সেন

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২১ ০৫:৫৬
Share:

১৮৯৭ সালে বালগঙ্গাধর টিলকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের বিচারকালে বিচারপতি আর্থার স্ট্রেচি-র পর্যবেক্ষণটি পরবর্তী কালে বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে যথেষ্ট সমালোচিত একটি বক্তব্য। তাঁর মত ছিল— দেশদ্রোহিতা হল ‘ঘৃণা, শত্রুতা, অপছন্দ, বৈরিতা, অবমাননা, এবং সরকারের প্রতি যে কোনও ধরনের অসাধু উদ্দেশ্যমূলক মনোভাব।’ ১৯৪১-এ যদিও ফেডারাল কোর্ট বা যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের বিচারপতি মরিস গোয়্যারের এক উদারমনস্ক রায়ে এই মনোভাব থেকে কিছুটা সরে আসা গিয়েছিল, কিন্তু ১৯৪৭-এ প্রিভি কাউন্সিল-এর সৌজন্যে পুনর্মূষিকো ভব। অতএব, রাষ্ট্রদ্রোহের এই সংজ্ঞাটি ভারতীয় আইনব্যবস্থাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রভাবিত হয়েছেন ভারতের নীতি-নির্ধারকেরা, কখনও বিচারব্যবস্থাও। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশেষত ‘সন্ত্রাসবাদ’, ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ এবং ‘ভারতের একতা ও অখণ্ডতা’-র মতো ‘বিপজ্জনক’ বিষয় যখন আদালতের সামনে আসে, সরকার নাগরিকের বাক্‌স্বাধীনতা খর্ব করার অজুহাত হিসাবে যখন এই বিষয়গুলি উত্থাপন করে, তখন বিচারবিভাগ বহু ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রদ্রোহের এই প্রচলিত ধারণাটিকেই গণ্য করে।

Advertisement

অভিনব চন্দ্রচূড়ের বইটির মূল প্রতিপাদ্য এটাই। অভিনব নিজে তৃতীয় প্রজন্মের আইনজীবী, ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন প্রধান বিচারপতি ছিলেন তাঁর পিতামহ প্রয়াত ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়; তাঁর বাবা বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করে সুপ্রিম কোর্টে এক অত্যন্ত জরুরি ভূমিকা পালন করেছেন। অভিনব বেশ হতাশ হয়েই বলছেন, ভারতের সংবিধান চালু হওয়ার পর আইনশাস্ত্রের হিসাবে বাক্‌স্বাধীনতার ইতিহাস দেখলে বোঝা যায় যে, “সংবিধান বলবৎ হওয়ার পরেও ভারতে বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারে কোনও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়নি।” (পৃ ৪) ‘অসহিষ্ণুতা’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’র মতো শব্দ যখন জনতার শব্দকোষে উজ্জ্বল স্থান অধিকার করে, তখন লেখকের প্রতিপাদ্যের গুরুত্ব স্বীকার না করে উপায় নেই।

রিপাবলিক অব রেটরিক: ফ্রি স্পিচ অ্যান্ড দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া
অভিনব চন্দ্রচূড়
৫৯৯.০০
পেঙ্গুয়িন

Advertisement

চট করে দেখলেই বোঝা যায় যে, বইটিকে দুটো ভাগে ভাগ করে দেখা সম্ভব— প্রথম অংশটি অধিকার হিসাবে বাক্‌স্বাধীনতার ঐতিহাসিক বিবর্তন নিয়ে কথা বলে; দ্বিতীয় অংশে আছে অশ্লীলতা, আদালত অবমাননা, ফৌজদারি মানহানি, বিদ্বেষাত্মক কথাবার্তা বা ‘হেট স্পিচ’, জাতীয় প্রতীকের অবমাননা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার মতো বেশ কিছু বিষয়। ১৯৫১ সালে প্রথম, এবং ১৯৬৩ সালে সপ্তদশ সংবিধান সংশোধনীর আগে দেশের সংবিধানসভা ও সংসদে যে বিতর্কগুলি হয়েছিল, সেগুলির কথা বিস্তৃত ভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোড়ন (যেমন, ১৯৬০-এর দশকে ‘দ্রাবিড়িস্থান’-এর জন্য ডিএমকে-র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং অবশ্যম্ভাবী কাশ্মীরের অনুষঙ্গ), যা নীতি-নির্ধারণকে প্রভাবিত করেছে, উঠেছে সেই কথাও। এসেছে সাম্প্রতিক কিছু বিতর্কের প্রসঙ্গও, যেমন সিনেমা হলে বাধ্যতামূলক ভাবে জাতীয় সঙ্গীত বাজানো বিষয়ক অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক (এই বিতর্কটি তৈরি হয়েছিল প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের একটি রায়ের ফলে— তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘সাংবিধানিক দেশভক্তি’ প্রদর্শনের দায়িত্ব পালন করতে হবে)। একই ভাবে, আদালত অবমাননা বিষয়ক অধ্যায়ে ১৭৬৫ সালে ‘রেক্স বনাম অ্যালমন’ মামলায় বিচারপতি উইলমট-এর অপ্রকাশিত রায়ের উল্লেখ করেন চন্দ্রচূড়। সেখানে বলা হয়েছিল, এই অবমাননা আইনের অস্তিত্বের আসল কারণ হল ‘বিচারপতিদের ঘিরে থাকা গৌরবের ঔজ্জ্বল্য অটুট রাখা’।

ভারতে আইন ও বিচারব্যবস্থা সংক্রান্ত বেশির ভাগ বই এবং আলোচনাই সীমাবদ্ধ থাকে সংবিধান সভা ও সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায়ের উদাহরণ দিয়ে বইটির কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্যকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায়। অভিনব চন্দ্রচূড় বহু ক্ষেত্রেই অন্যান্য নথিপত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন, সংসদীয় ও সিলেক্ট কমিটির কার্যবিবরণী, অথবা চিঠি ও বক্তৃতার আকারে রাজনীতিকদের মতামত। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা জরুরি যে, অভিনব তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন, প্রথম সংবিধান সংশোধনীর আগে বিভিন্ন বক্তৃতায় ও চিঠিপত্রে বাক্‌স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এখন যাঁরা দিল্লির তখ্‌তে আসীন, বাক্‌স্বাধীনতার প্রসঙ্গে তাঁদের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে শ্যামাপ্রসাদের অবস্থানটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভাল।

তেমনই অনেক বিচারপতি ও আইনি দিকপালের ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারও ব্যবহার করেছেন অভিনব। সুপ্রিম হুইসপার্স: কনভারসেশনস উইথ জাজেজ় অব দ্য সুপ্রিম কোর্ট অব ইন্ডিয়া (১৯৮০-৯০) শিরোনামের বিখ্যাত বইটির মতো এ গ্রন্থেও আমেরিকান পণ্ডিত জর্জ গ্যাডবোয়ার গবেষণামূলক মৌলিক কাজগুলির উল্লেখ রয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের সঙ্গে কথোপকথন ও সাক্ষাৎকারে অযুত সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিলেন গ্যাডবোয়া, উঠে এসেছিল নীতি-নির্ধারণের ভিত্তি হিসাবে থাকা আদর্শ ও চিন্তাধারার কথা।

ভারতে বাক্‌স্বাধীনতা ও তজ্জনিত ক্ষোভ নিয়ে বেশ কিছু বই আছে, যেখানে বিষয়টিকে নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়েছে। কিছু বই ‘ডেলিবারেটিভ ডেমোক্র্যাসি’ বা আলোচনাভিত্তিক গণতন্ত্রে বাক্‌স্বাধীনতার কার্যকারিতা নিয়ে দার্শনিক অবস্থানের কথা বলে। অন্য কিছু বই শুধুই বাক্‌স্বাধীনতার উপর সরকারি হস্তক্ষেপে বিচারব্যবস্থার প্রতিক্রিয়ার কথা জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এই দুই ভাবনার কোনওটিরই শরিক হয় না রিপাবলিক অব রেটরিক। এ হল এমন এক চমৎকার দলিল, যেখানে বিভিন্ন গল্প আর টুকরো অভিজ্ঞতার বর্ণনার সূত্রে মূল বক্তব্যগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং তার ফলে আইনি পরিভাষার ব্যবহারও প্রায় নেই। যাঁরা গণতন্ত্রে বিবিধ স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করেন, এবং তার মূল্য বোঝেন, তেমন প্রত্যেক নাগরিকেরই এই বইটি অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। বইটি যেন কেবল আইনজীবীদের গ্রন্থাগারের ভূষণ না হয়ে ওঠে।

প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক জুর্গেন হাবারমাস ১৯৭০-এর দশকে দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন যে, গণপরিসর নামক বস্তুটি ক্রমশই ক্ষয়ে যাচ্ছে। পারস্পরিক আদানপ্রদান, আলোচনার মাধ্যমে এই পরিসরটিতেই জন্ম হয় নতুন চিন্তার, নতুন মতবাদের। হাবারমাস এই প্রবণতার দায়টি চাপিয়েছিলেন টেলিভিশনের উপর। ‘বোকা বাক্স’টি তখন সদ্য বাড়িতে বাড়িতে প্রবেশ করেছে, জাঁকিয়ে বসেছে ড্রয়িংরুমে, এবং একতরফা তথ্য গিলিয়ে দেওয়ার অভ্যাসটিকে ক্রমশ প্রতিষ্ঠা করছে জনপরিসরে। ফলে, মানুষের চিন্তা করার, প্রশ্ন করার ক্ষমতাও ক্রমেই কমছে। ইদানীং মানুষের বাক্‌স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। তার একটা কারণ অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদ, যা সংখ্যালঘুর অপ্রিয় মতামতকে খাটো চোখে দেখে, তাকে দমন করতে চায়। কিন্তু, অন্য কারণও আছে। ক’জন মানুষই বা জানেন যে, সংবিধান আমাদের বাক্‌স্বাধীনতার কী বিপুল এক পরিসর দিয়েছে, রাষ্ট্র যাতে নাগরিকের এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, তার জন্য কঠোর ভাবে বেঁধে দিয়েছে রাষ্ট্রশক্তির হাত? এই বই ধরে ধরে দেখিয়েছে যে, সংবিধান রাষ্ট্রের জন্য নাগরিকের বাক্‌স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে কী সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে, এবং সেই হস্তক্ষেপকে ‘বৈধ’ প্রতিপন্ন করতে হলে রাষ্ট্রকে কী ভাবে যুক্তির কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ হতে হবে। এই কাজটি করার জন্য লেখক অবশ্যই ধন্যবাদার্হ।

শেষে একটা অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করি। আমরা ক’জন জানি যে, ‘সিবিএফসি’ (সেন্সর বোর্ড নামেই যা সমধিক পরিচিত) শোলে ছবির ক্লাইম্যাক্স পাল্টানোর নির্দেশ দিয়েছিল? মূল চিত্রনাট্যে ঠাকুরের হাতে খুন হয়েছিল গব্বর সিংহ। কিন্তু, ভারতরাষ্ট্র তো নীতি-অভিভাবক এবং জনরুচির নিয়ন্ত্রক, অতএব সিনেমার এমন পরিণতি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জনমনে ভুল বার্তা দিতে পারে বলে মনে করা হয়েছিল। এমন আরও কাহিনি শুনতে চান? তা হলে এই বইটি অবশ্যই পড়ুন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement