স্রষ্টা: জীবন থেকে পৌঁছন সৃষ্টিতে। সেলিনা হোসেন (জ. ১৯৪৭)
প্রবন্ধ সংকলন/ সেলিনা হোসেন
সম্পাদক: সুশীল সাহা
৬০০.০০
আনন্দ পাবলিশার্স
চুয়াল্লিশটি প্রবন্ধ-নিবন্ধ, বিচিত্র তার বিষয়, বিষয়গুলি পরস্পর অন্বিতও বটে। মোট সাতটি বিভাগে বিন্যস্ত তারা— ‘ভাষা’, ‘সাহিত্য, ‘সংস্কৃতি’, ‘নারী’, ‘বিবিধ’, আত্মজৈবনিক’ আর ‘ভ্রমণ’। শেষ দু’টি বিভাগের লেখাগুলি পড়তে পড়তে পাঠকের মন ফিরে যেতে পারে সেলিনা হোসেনের গল্প-উপন্যাসের দুয়ারে। সাহিত্যিক তাঁর সৃষ্টিকে কোনও না কোনও ভাবে যাপন করেন নিজের জীবনে। তিনি জীবন থেকে সৃষ্টিতে পৌঁছন। পাঠক সেই সৃষ্টিকে ভেঙে ভেঙে পৌঁছতে পারেন স্রষ্টার জীবনে। পাঠকের নাগালে যে যাত্রাপথটি থাকে, সে পথের বাঁকে বাঁকে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতার সূত্রে পাঠক ছুঁতে চান স্রষ্টার পথটির দিশা। সেলিনার আখ্যান যাঁরা পরম মনোযোগে পড়েন, তাঁদের কাছে শেষ দু’টি বিভাগ তাই একান্ত মূল্যবান।
দীর্ঘ সময় জুড়ে লেখা অনেকগুলি প্রবন্ধ, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা আছে এই সঙ্কলনে। ‘সংস্কৃতি ও সাধারণ মানুষ’ প্রবন্ধে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ চলচ্চিত্রটির প্রবল বাণিজ্যিক সাফল্য আর সেই সাফল্যের কার্যকারণ প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পাঠককে দাঁড় করায় সাংস্কৃতিক মাধ্যমের শিল্পসম্মতি এবং জীবনসঙ্গতি নিয়ে জরুরি প্রশ্নের সামনে। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স যখন দুই দশক, তখন সেলিনা লিখেছিলেন, ‘সমাজ আজ এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, শুধু একজন বেগম রোকেয়ায় হবে না, হাজার হাজার রোকেয়া চাই।’ (‘বেগম রোকেয়াকে আমাদের কেন প্রয়োজন’, পৃ ৩৭৩)। ব্যতিক্রম যদি ব্যতিক্রমের ঘের ভেঙে নিয়ম হয়ে ওঠে, তবেই আকাঙ্ক্ষিত উজ্জীবন সম্ভব, এমন ইঙ্গিতই সম্ভবত ছিল ওই উচ্চারণে। ব্যতিক্রমী কাহিনি বিছিয়ে বিছিয়ে সমাজের অগ্রগমন আর আলোকপ্রাপ্তিকে মাপতে চাওয়ার ভিতরে যে গলদ, তাকেই হয়তো সেলিনা পরোক্ষে ধরিয়ে দিতে চান। ‘শান্তি ও বাংলাদেশ’ (পৃ ৩৯১-৪১১) প্রবন্ধে বাংলাদেশের সমস্যাবলির অবয়ব আরও স্পষ্ট হতে পারত। কর্তব্যের প্রসঙ্গ সেলিনার মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্বের কলমে এলে পাঠকেরই সমৃদ্ধি। তবে পাঠক বোধ হয় সমৃদ্ধতর হতেন, সেলিনার দেশে ‘করণীয়’ আর ‘কৃত’-র ব্যবধান কতখানি দুস্তর, তার স্পষ্টতর দিশা পেলে। ‘সংস্কৃতি ও নারী’ (পৃ ২১৬-২৪০) বা ‘সংস্কৃতি ও শিশু’-র (পৃ ১৮৩-২১৫) মতো শক্তপোক্ত প্রবন্ধ যিনি লেখেন, অলীক ইচ্ছাপূরণের লেশমাত্রকে প্রশ্রয় না দিয়ে, তাঁর কাছে পাঠকের প্রত্যাশা প্রচুর।
‘বিংশ শতাব্দীর বাংলা উপন্যাস: রূপ-রূপান্তর’ লেখাটিতে বিভূতিভূষণ থেকে দেবেশ রায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে শহীদুল্লা কায়সার বা আবু ইসহাকের সৃষ্টির প্রসঙ্গ এসেছে। ১৯৯৯ সালে পঠিত বক্তৃতার লিখিত এই রূপটিতে নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্ট প্রসঙ্গ আসেনি। আসেনি বাংলাদেশের ও গত শতকের নব্বইয়ের দশকের নতুন লেখকদের কথা। এ পার বাংলায় দেবেশ রায় পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের তখন নতুন সঙ্কট। সাবেক বাস্তববাদের ঘেরে আর বাঁধা যাচ্ছে না চতুষ্পার্শ্বের বাস্তবকে। কিস্সায় অথবা রূপকথার ছলে অ-রূপকথায় নতুন বয়ান খুঁজছেন তাঁরা। ১৯৯৯-এর বক্তৃতা ২০১৯-এ যখন প্রবন্ধ সঙ্কলনে গ্রন্থিত হচ্ছে, তার অনেক আগে শাহীন আখতার লিখেছেন তাঁর তালাশ (মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০৪) উপন্যাস। গ্রন্থিত প্রবন্ধগুলি এতখানি সময় জুড়ে লেখা যে, মাঝেমধ্যে মনে হয়, তাদের বিনিসুতোয় একটি সঙ্কলনে গাঁথবার জন্য হয়তো প্রাবন্ধিকের নিজস্ব পরিবর্ধন বা পরিমার্জন প্রয়োজন ছিল। তৈরি হতে পারত একটি দু’টি মূল্যবান পরিশিষ্ট।
১৯৯৩-এ সেলিনা হোসেন লিখেছিলেন, ‘... একাডেমিক রিসার্চ থেকে যোগাযোগের জায়গায় আসছি... সেখান থেকে উপন্যাস নিচ্ছি, আবার সাহিত্য থেকে রিসার্চের জায়গায় যাচ্ছি। অধ্যাপক পাস্কাল জিঙ্কের গবেষণার বিষয় ছিল সাউথ এশিয়ার লিটারেচারে প্রতিফলিত ভায়োলেন্স। আমার উপন্যাসকে এই গোত্রে ফেলব কিনা এই চিন্তা থেকে তাকে বলি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভায়োলেন্স নয়। তা লিবারেশন ওয়ার।’ (‘যোগাযোগের মৌলিকত্বে সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, পৃ ৪৪)। সেলিনার উচ্চারণের নিশ্চয়তাই আরও বেশি করে মনে আনে প্রবন্ধটির এগারো বছর পরে গ্রন্থিত তালাশ উপন্যাসটির কথা। ১৯৭১-এ জন্মেছিল মেয়েটি, মা-বাবা নাম রেখেছিলেন মুক্তি। ইতিহাসের ছাত্রী মুক্তি দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করার সুবাদে বার বার দেখল, লিবারেশন ওয়ার আর ভায়োলেন্স কী ভাবে একে অন্যের উপর চেপে বসে আছে, আলাদা করা অসম্ভব। মুক্তির অন্তর্লীন বীভৎস সব বন্ধন দেখতে দেখতে মেয়েটি পর্যুদস্ত। খুব সম্প্রতি সুনন্দা সিকদার তাঁর দয়াময়ীর ফিরে দেখা (দীপ প্রকাশন, ২০১৯) শীর্ষক স্মৃতিকথায় ওই লিবারেশন ওয়ার-এর অন্য এক রেশ বিছিয়ে দিয়েছেন। স্বাধীন হল কারা, সে স্বাধীনতার খরচই বা দিল কারা, এ সব জটিল প্রশ্ন বাদ দেওয়া চলে না। তাই বলছিলাম, ও পারের শাহীন বা এ পারের সুনন্দার দেখা আর দেখানো লিবারেশন ওয়ার বনাম ভায়োলেন্স-এর প্রেক্ষিতে যুক্ত হলে আলোচ্য প্রবন্ধ সঙ্কলনটির গুরুত্ব বাড়ত। সেলিনাই তো লিখেছেন, ‘পাহাড়ি জনপদে জীবনের অন্বেষা’-র (পৃ ৪৪৪-৪৬৭) মতো যন্ত্রণাবিদ্ধ বিবরণ! অসঙ্গতির চিত্রণে তবে আরও সঙ্গতি চাইবেন না পাঠক?
দীর্ঘ সময় ধরে লেখা প্রবন্ধগুলির সঙ্কলন যদি আজকের মতো সমস্যাদীর্ণ সময়ে প্রকাশিত হয়, তবে আরও খানিকটা যত্ন আর অভিনিবেশ দরকার।