নবযুগ: কলকাতা শহরে স্বাধীনতার আনন্দ উদ্যাপন, ১৫ অগস্ট, ১৯৪৭
ওয়ার্ল্ডমেকিং আফটার এম্পায়ার: দ্য রাইজ় অ্যান্ড ফল অব সেল্ফ-ডিটারমিনেশন
এডোম গেটাচিউ
১৯২১.০০
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা পেয়েছিল, এবং কিছুটা অংশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যে দেশ স্বাধীনতা চেয়েছিল, এবং যে ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হল, দুটো কি এক? বিশেষ করে যখন এমন রক্তক্ষয়ী দেশভাগ হিন্দু-মুসলমান কেউই কল্পনা করেনি? না কি, অন্য কোনও রকম দেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল এক সময়ে, যা চল্লিশের দশকের যুদ্ধ-মারামারিতে আস্তে আস্তে নিবে যায়?
শুধু ভারতের ইতিহাস পড়লে এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল। কারণ, এ দেশের ডান-বাম-উদারপন্থী ইতিহাসচর্চার অনেকটাই ভারত-রাষ্ট্রের প্রেমে মুগ্ধ; তা নেহরু, আম্বেডকর, বা এমনকি শ্যামাপ্রসাদ— যে মার্কাই হোক না কেন। দেশপ্রেমে দোষ নেই, সমস্যা হয় যখন অতিভক্তি অতীতকে একমাত্রিক ভাবে দেখায়। তা থেকে আমরা মনেই করতে পারি না যে, ১৯৪৭ সালে অনেক রকম পথ খোলা ছিল, তার মধ্যে থেকে একটা রাষ্ট্রীয় কাঠামো বেছে নেওয়া হয়, যে কাঠামোর সঙ্গে ইংরেজ শাসনের বিরাট মিল। অন্য কী কী পথ ছিল; কী হতে পারত; হল না কেন— এ নিয়ে বেশির ভাগ ভারতীয় ইতিহাসবিদ খানিক নির্বিকার। নেহরুর ভারত যে তাঁদের কাছে সকল দেশের রানি, সেটা একেবারে অকারণে নয়, তা ঠিক— কিন্তু, মুশকিল হল, সেই গণ্ডি তাঁরা কোনও মতেই ছাড়াতে নারাজ।
পৃথিবীর অন্যত্র কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরেই এই সমস্ত প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষত আফ্রিকায়, যেখানে গত শতকের মধ্য ভাগ থেকে রাষ্ট্র ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। ছয়-সাত বছর আগে ফ্রেডরিক কুপার ও গ্যারি ওয়াইল্ডারের মতো ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছিলেন যে, আফ্রিকার বেশ কিছু রাষ্ট্রনায়ক— বিশেষত সেনেগালের লেওপোল্ড সিডার সঙ্গর— স্বাধীন রাষ্ট্র চাননি। চেয়েছিলেন ইউরোপীয় শক্তি ফ্রান্সের সঙ্গে এক রকমের মিলিত দেশ, যেখানে ফরাসি এবং আফ্রিকান দুই-ই সমান হয়ে থাকবে। প্রস্তাবটি বিতর্কিত, এবং এমন ‘আন্তর্জাতিক’ নাগরিকত্ব নিয়ে আমেরিকায় আজকাল লাফালাফি হলেও, মনে হয় না এই জাতীয় মিলনের বিশেষ সারবত্তা কোনও দিনই ছিল, কারণ সাহেবরা কখনওই কৃষ্ণাঙ্গদের সমান নাগরিক বলে স্বীকার করেনি। ঢের গুরুত্বপূর্ণ ছিল আফ্রিকার অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গ দেশ-জাতির নিজেদের মধ্যে এক রকম বোঝাপড়ায় আসা, কারণ সেটাই বাস্তব। ভারতভূমির মতোই নিজেদের ভিতর খেয়োখেয়িতে আফ্রিকার ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। অবশেষে এডোম গেটাচিউ এ প্রশ্নটিতে খানিক আলোকপাত করেছেন। তাঁর বইটি চল্লিশের দশককে বুঝতে সাহায্য করে।
এডোম ইতিহাসবিদ নন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তাঁর লক্ষ্য বিশ শতকের মধ্যভাগে ‘স্বাধীনতা’ বা ‘সেল্ফ-ডিটারমিনেশন’ নামক তত্ত্বের বিশ্লেষণ করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে পৃথিবীর সমস্ত দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে লিগ অব নেশনস সৃষ্টি হয়, তার ভিত্তি যে একেবারে শ্বেতাঙ্গ শক্তিতে নিহিত ছিল, তা এডোম-সহ পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা আজ নতুন করে বুঝছেন। তবে, ঋষি অরবিন্দের মতো ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই গল্পটি গোড়া থেকেই জানতেন, কারণ তখন ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ দেশগুলি স্বাধীনতা পেলেও এশীয়-আফ্রিকানরা ব্রিটিশ-ফরাসি হাতেই বন্দি রইল। এডোমের বইয়ের প্রথমার্ধ এই শ্বেতাঙ্গ-ক্ষমতা সৃষ্টির গল্পের পুনরাবৃত্তি। বইটির মূল অবদান তার দ্বিতীয়ার্ধে, যেখানে এডোম দাবি করেন যে, আফ্রিকা এবং ক্যারিবিয়ানের কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রনায়ক-চিন্তকেরা ১৯৪০-এর দশকে এই শ্বেতাঙ্গ-ক্ষমতার শিকল ভেঙে একটি নতুন দুনিয়া (‘ওয়ার্ল্ড’) সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ, কেবল সাহেব তাড়িয়ে সাহেবের তৈরি রাষ্ট্র (গাঁধীর ভাষায়, ইংরেজ ছাড়া ইংরেজ শাসন) নয়। শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যের পতন মানে পুরনো দুনিয়া শেষ, এক নতুন দিনের শুরু, যেখানে জাতি আর বর্ণভেদ রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে না।
অতলান্তিকের দুই পারেই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, মাঝে কেবল সাহেবের টানা সীমান্তরেখা— সে যুগের বহু চিন্তক ও রাজনীতিক এই ভেদ মেনে নিতে পারেননি। সেই তথাকথিত ‘প্যান-আফ্রিকান’ দলে ছিলেন ঘানার কোয়ামে ইনক্রুমা, ত্রিনিদাদের জর্জ প্যাডমোর ও এরিক উইলিয়ামস (যিনি স্বনামধন্য ইতিহাসবিদও), আমেরিকার ডুবোয়া, জামাইকার মাইকেল ম্যানলি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাহেবি খাঁচায় এই সমস্ত দেশনায়ক এত দিন ধর্তব্যের মধ্যেই আসেননি, এডোমের অসীম কৃতিত্ব এঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ায়। এঁরা কেউই শুধু আয়েশে বুলি ঝাড়ার পাত্র ছিলেন না, তা সফল করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। এর একটি ফল ছিল, ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত ক্যারিবিয়ানের অধিকাংশ দ্বীপ মিলেমিশে একটি দেশ হয়েছিল— ওয়েস্ট ইন্ডিজ়। সেই রাজনৈতিক মিলন জামাইকা-ত্রিনিদাদের রেষারেষিতে অকালে শেষ হলেও রয়ে গিয়েছে একটি ছাপ, আজও সেই দেশসমষ্টির মিলনেই তাদের ক্রিকেট দল।
অনেক সময়ে এই জাতীয় বিদ্যাচর্চাকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সমালোচনা খানিক যুক্তিযুক্তও, কারণ সুন্দর পৃথিবী গড়ার দিবাস্বপ্ন অনেকেই দেখেন এবং সচরাচর স্বপ্ন সত্যি হয় না। কিন্তু এডোমের গবেষণা দেখায় যে, বিশ শতকের মধ্য ভাগে ইউরোপীয় ধাঁচের জাতি-রাষ্ট্রের বাইরেও অন্য রকম সমাজ ও রাজনীতির রূপরেখা ছিল, এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের মতো কিছু জায়গায় তা সফলও হয়েছিল, একই সময়ে মিশর ও সিরিয়াও এই ভাবে মিলিত হয়েছিল। আর ভারতকে এই চোখে দেখলে তো কথাই নেই, কারণ দেশভাগ আটকানোর জন্য বহু মানুষ শেষ অবধি প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন, শরৎচন্দ্র বসুর অবিভক্ত সার্বভৌম বঙ্গের পরিকল্পনাও অনেক দূর এগিয়েছিল। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে বরং জাতি-ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের ধারণাটিই নতুন, বহু কাল ধরে এখানে অসংখ্য জাতি-ধর্মের মানুষ তাদের বন্ধুত্ব, ঝগড়া সব নিয়েই আছে। এমন ‘ফেডারাল’ মিলন আফ্রিকার ক্ষেত্রে বিশ শতকে নতুন হতে পারে, এশিয়ায় এর ঐতিহ্য বহু পুরনো।
‘ফেডারাল’ বলে এডোম যা বোঝেন তা খানিক সঙ্কীর্ণ, কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণ এবং খ্রিস্টধর্মের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ, কেবল চল্লিশের দশকের একটি মুহূর্তের চিন্তা। কিন্তু ভারত বা এশিয়ার ফেডারাল চিন্তাধারার পরিসর অনেক বড় ছিল, তার ভিত্তিই ছিল নানা ভাষা-ধর্মের মানুষের একত্র সহাবস্থান। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এই চিন্তার পথিকৃৎ, তাঁর বেঙ্গল হিন্দু-মুসলিম প্যাক্ট কোনও অংশে ক্যারিবিয়ান রাষ্ট্রনায়কদের চেয়ে কম যুগান্তকারী ছিল না, এবং সেই রাজনীতির গভীর প্রভাব আজও একেবারে মুছে যায়নি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ হঠাৎ করে সব হিসেব পাল্টে দেয়, কিন্তু ভুলতে পারি না যে, স্বয়ং জিন্না পাকিস্তান গঠন হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত ভারতের হিন্দু-মুসলমানের ফেডারাল মিলনের পক্ষে ছিলেন। এটুকু বলাই যায় যে, সেই ফেডারেশন এমন কিছু কষ্টকল্পিত ছিল না, এবং তার ক্ষমতাবিন্যাস ও সংস্কৃতি আধুনিক ভারত-পাকিস্তানের মতো হত না। সেই দেশ আজ আমাদের কল্পনার অতীত হতে পারে, কিন্তু একশো বছর আগে সেই দেশই ছিল বর্তমান, একশো বছর পরে আবার ফিরেও আসতে পারে। আমাদের দায়িত্ব মাঝের সময়টায় সেই কল্পনার, সেই সংগ্রামের স্মৃতিটুকু জাগিয়ে রাখা।
ক্যারিবিয়ান নিয়ে আলোচনা যখন, শেষ করি আমার এক প্রিয় ইতিহাসবিদকে দিয়ে— সিএলআর জেমস। যিনি একাধারে ইতিহাসবিদ, ক্যারিবিয়ান ফেডারেশনের প্রবক্তা এবং ক্রিকেট-সাংবাদিক। ১৯৬০ সালে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের রাজনৈতিক মিলন ভাঙতে শুরু করেছে ত্রিনিদাদ ও জামাইকার শত্রুতার কারণে, জেমস তাঁর ‘শত্রু’ দেশ জামাইকার ক্রিকেটার ফ্রাঙ্ক ওরেলকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন করার জন্য অক্লান্ত লেখালিখি শুরু করলেন। এর আগে কেবলমাত্র সাদা মানুষ ক্যাপ্টেন হতেন, কিন্তু ওরেল প্রথম ক্যাপ্টেন হলেন জেমসের একক চেষ্টায়, তার পরে অস্ট্রেলিয়া সফরে চূড়ান্ত সাফল্য পেলেন। দু’বছর পরে, তখন ফেডারেশন অতীতমাত্র, ত্রিনিদাদের জেমস লিখলেন যে, জামাইকার ওরেলের জন্যই তাঁর দেশ বিশ্ব-দরবারে স্থান পেয়েছে। রাজনৈতিক ছক গুলিয়ে যায়, কিন্তু পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিতে তৈরি বন্ধুত্বের সেতু সহজে ভাঙে না।
আজও আশা, জাতীয় বিভেদের গরলে চোবানো আমাদের দেশের ক্রিকেটও এক দিন এই মিলনের, বন্ধুত্বের স্বাধীনতার স্বাদ পাবে।