“সত্যি কথা বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার।”— শঙ্খ ঘোষের এই উক্তি ধরেই সঙ্কলনটি সাজিয়েছেন অনুবাদক। উর্দু থেকে তর্জমার সময়ে ফয়েজ়-উত্তর পাকিস্তানের ন’জন কবিকে বেছে নিয়েছেন, যার মধ্যে কবি পুরুষ পাঁচ জন। ফয়েজ়ের কথা দিয়েই শুরু করেছেন তিনি। কোনও দিন গলা তুলে কথা বলতে না পারা ফয়েজ়কে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারের দশ ফুট বাই দশ ফুট দেওয়ালে কাঠকয়লার টুকরো দিয়ে ফয়েজ় লিখে রাখেন চৌপদ। যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন জিন্না কোটি কোটি মুসলমানকে দেখিয়েছিলেন, স্বাধীনতার পাঁচ বছর যেতে না যেতেই সামন্ততান্ত্রিক প্রভু, রক্ষণশীল মোল্লা, সেনাবাহিনীর এক দল উচ্চপদস্থ অফিসারের অপরিসীম লোভের ‘খাঁচায়’ তা ধ্বংস হয়ে গেল। ‘ছিনিয়ে নেওয়া ইতিহাস’-কে ভরকেন্দ্র করে কোনও ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’-এর সন্ধানে ব্যর্থ পাকিস্তানের কবিরা রাতের অন্ধকারে গেরিলা হানায় অব্যর্থ হয়ে উঠলেন।
১৮৭৫ সালে জন্মেছেন, ও ভারতেই থেকে গিয়েছেন হসরত মোহানি। তাঁর পথেই যেন পাকিস্তানের উর্দু কবিতার প্রধান ধারা এগিয়েছে। “গান্ধী কি তরহা বয়েঠকে কাটেঙ্গে কিউ চরখা/ লেনিন কি তরহা দেঙ্গে দুনিয়াকো হিলা হম।” মহা ইসলামি স্বপ্ন ধ্বংস করে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ। খান সেনার অত্যাচার ও ভারতের কাছে হার, এই দুই লজ্জার অংশীদার হতে হয়েছে তাঁদের। ‘ঢাকা থেকে ফিরে’ কবিতায় ফয়েজ় সমর্থন করছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। আফজ়াল আহমেদ সৈয়দ শৈশব, যৌবন ঢাকায় কাটিয়েছেন। ১৯৭১-এ যুদ্ধ শেষের পর নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে পালাতে হয়েছে। তাঁর লেখায় আসে সাধারণ এক বাংলাদেশি মেয়ের কথা: “তার দরিদ্র দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে/ সে দুনিয়ার সবথেকে বেশি স্বাধীন এবং বেশি খুশি।”
সরোয়াত হুসেনের ‘একজন মানুষের মৃত্যু’ কবিতায় পাকিস্তানি সেনার বর্বরতা নিয়ে আত্মধিক্কার— “থেমে গেলে কেন, কোন কিছু বলছ না কেন মজুমদার?... নাও, আখ ছোলার কাটারি/ কেটে ফেলো এই পা দুটো/ আলাদা করে দাও এ দুটো।”
নতুন ভাষার অক্ষর: ফয়েজ়-উত্তর
পাকিস্তানের উর্দু কবিতানীলাঞ্জন হাজরা৫০০.০০
চিন্তা প্রকাশনী
রাষ্ট্রপুঞ্জে দেওয়া হুমকি তাঁদের নয়, তাঁদের নামে করা অদ্ভুত সব আইন, ধর্মের রক্তচোখ, ইতিহাসও তাঁদের নয়। একটা ধোঁকাবাজ রাষ্ট্রকাঠামোর বিরুদ্ধে আফজ়াল আহমেদ সৈয়দ লিখছেন, “দেশের প্রেসিডেন্ট চোখে পট্টি বেঁধে/ মেলায় একটা বোর্ডে আঁকা গাধার স্কেচের ওপর/ তার লেজের টুকরোটা পিন দিয়ে সঠিক জায়গায় লাগানোর চেষ্টা করছেন।”
রাষ্ট্রকাঠামোর নীচের তলার বাসিন্দা নারীবিশ্বের কথা উঠে এসেছে ১৯৪০-এ জন্মানো কিশওয়র নাহিদের লেখায়: “আমি কবিতা লিখি/ কারণ আমি আত্মহত্যা করিনি/ আমিজীবনে শামিল/ কারণ আমি কারো প্রেমাস্পদ হইনি।”
১৯৪৬ সালে জন্মানো প্রতিবাদী ফাহমিদা রিয়াজ়ের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে চোদ্দোটি মামলা রুজু হয়, যার একটিতে মৃত্যুদণ্ড বহাল ছিল। ভারতে পালিয়ে এসে অমৃতা প্রীতমের কাছে সাত বছর ছিলেন তিনি। তাঁর সময়ে ‘হলুদ আইন’ জারি করে ইসলামি শাসনের নামে মহিলাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে ফিরিয়ে আনা হল চাবুক মারা, হাত পা কেটে ছেড়ে দেওয়া, পাথর মেরে মেরে হত্যা— তাঁর অতি বিতর্কিত কবিতাটি সঙ্কলনে শ্রেষ্ঠ সম্পদ। “লম্বা ঊরুর ওপরে দেখো/ উদ্ভিন্ন স্তনের ওপরে দেখো/ আকলিমার একটা মাথাও আছে, দেখো।”
সারা শগুফতা ১৯৫৪ সালে জন্মেছিলেন, গণ্ডি ছাপানোর ব্যর্থতার অমোঘ বিষাদে আত্মহত্যায় জীবনের সমাপ্তি। শাণিত ব্যঙ্গে দেখাচ্ছেন,কবি পুরুষেরা ‘অর্ধেক কামরা’য় থাকা কবি মেয়েদের ভুলে যাচ্ছেন। “ছন্দ মেলাতে গিয়ে সার্ত্র মেয়েদের নাম খুব বেশি রাখতে পারছেন না... গালিবের মনে হচ্ছে বকবক করছ... স্যাফো, স্যাফো আমার, মীরাবাইয়ের মতো কথা বোলো না।”
যে কাব্যভাষার অন্তর্নিহিত ভরকেন্দ্র উদ্বেগ, ধারালো ও অপ্রত্যাশিত, সেই কবিতাগুলি অনুবাদকের তর্জমায় পাঠককে সংক্রমিত করে রাখে।