যুগপুরুষ: রাজা রামমোহন রায়। —ফাইল চিত্র।
রামমোহন রায়ের (১৭৭২–১৮৩৩) জন্মের সার্ধদ্বিশতবর্ষে বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনাসভা ছাড়াও বেশ কিছু ভাল গবেষণালব্ধ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই ধারায় নবতম সংযোজন অভিজিৎকুমার ঘোষ ও প্রকাশচন্দ্র সরকার সম্পাদিত একুশ শতকের চোখে রামমোহন। ভূমিকায় সম্পাদকদ্বয় বলেছেন, একুশ শতকের সচেতন মানুষ রামমোহনকে নিয়ে কী ভাবছেন, কোন চোখে দেখছেন তাঁর সংস্কার প্রয়াসকে, তা জানার আগ্রহ থেকেই এই বইয়ের পরিকল্পনা। প্রবীণ ও নবীন রামমোহন-অনুরাগীরা রামমোহনের সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, রাজনীতি, সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। সম্পাদকদ্বয়ের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়, কিন্তু কয়েকটি বিষয়ে আরও যত্নবান হলে ভাল হত। প্রচ্ছদের ভিতরের ব্লার্বে লেখা— রামমোহনের জন্মসাল ১৭৭৪। এই ত্রুটিটি বেশ কিছু প্রবন্ধের মধ্যেও লক্ষ করা গেছে, যেমন অনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রামমোহন রায় ও ব্রাহ্মসমাজ’ ইত্যাদি।
এই সঙ্কলনে স্বপন বসু রামমোহনের সমকালীন সমাজ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সঙ্কলনটির বিশেষত্ব রামমোহনের কয়েকটি অনালোচিত বিষয়ে আলোকপাত করা। রমেনকুমার সর আলোচনা করেছেন রামমোহন ও সমাচার চন্দ্রিকা-র ভবানীচরণকে নিয়ে, সাইফুল্লা লিখেছেন রামমোহন ও মুসলমান সমাজ, অভিজিৎকুমার ঘোষ লিখেছেন রামমোহন ও ইয়ং বেঙ্গল নিয়ে; মঞ্জুলা বেরা রামমোহনের অনুগামীদের উপর আলোকপাত করেছেন। রমেন সরের লেখার মধ্যে কোনও উল্লেখপঞ্জি নেই— উদ্ধৃতিগুলোর উৎস দেওয়া থাকলে গবেষকদের জন্য অনেক সুবিধা হতে পারে। মুসলমানদের চোখে রামমোহন, এই বিষয়ে বলতে গেলে সৈয়দ মুজতবা আলী, শামস্-উন-নাহার, কাজী আদব্দুল ওদুদ ও হালে মুনতাসীর মামুনের কথা বিশেষ ভাবে মনে পড়ে। সাইফুল্লার লেখার মধ্যে এই সকল লেখকের কোনও উল্লেখ পাই না।
অতনুশাসন মুখোপাধ্যায়ের লেখায় রামমোহনকে নিয়ে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভাবধারার দ্বন্দ্ব নিয়ে সুন্দর আলোচনা রয়েছে। ত্রিতত্ত্ববাদী ও একেশ্বরবাদী ইউনিটেরিয়ানরা, উভয়েই রামমোহনকে তাঁদের ধর্মের সমর্থক মনে করতেন। এই প্রসঙ্গে নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় রচিত রামমোহন-জীবনীতে বলা আছে— রামমোহন বিলাত গমনের পূর্বে নন্দকিশোর বসুকে বলেন, প্রতিটি ধর্মের লোক রামমোহনকে তাঁদের ধর্মাবলম্বী মনে করবেন। হিন্দুরা তাঁকে বৈদান্তিক হিন্দু বলবেন, খ্রিস্টানরা তাঁকে ইউনিটেরিয়ান বলবেন আর মুসলমানেরা তাঁকে মুসলমান জ্ঞান করবেন। শিক্ষা সংস্কারক রামমোহন নিয়ে আলোচনা করেছেন সুবিমল মিশ্র। এখানে একটি তথ্যগত ভুল আছে— রামমোহন লর্ড আমহার্স্টকে চিঠিটি লিখেছিলেন ১১ ডিসেম্বর ১৮২৩, ১২ ডিসেম্বর নয়। লেখাটির শেষে তথ্যপঞ্জি দেওয়া আছে, কিন্তু মূল লেখাটিতে কোনও সূত্র না দেওয়ায়, গবেষকদের একটু অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে।
প্রশান্ত ধরের লেখায় রামমোহনের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ ও স্বদেশবাসীর সার্বিক কল্যাণ ও অধিকারের প্রতি তাঁর নিরলস প্রয়াসের সুচিন্তিত মূল্যায়ন করা হয়েছে। অঞ্জন বেরার বিষয় রামমোহনের সাংবাদিকতা। তাঁর আলোচনায় রামমোহন যে সব সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। সম্বাদ কৌমুদী প্রকাশিত হত প্রতি মঙ্গলবার, এবং তার মাসিক মূল্য ছিল দুই টাকা। রামমোহন এই পত্রিকাটি ‘পেপার অব দ্য পাবলিক’ হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন— যেখানে এ দেশের মানুষ তাঁদের অভাব-অভিযোগ প্রকাশের জন্য বাংলায় কলম ধরতে পারবেন। মীরাৎ উল আখবার-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, দেশের জনগণ যাতে সরকারের চালু করা বিভিন্ন আইন সম্পর্কে জানতে পারে। এখানে একটি তথ্যগত ভুল আছে: রামমোহন ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন ২০ অগস্ট ১৮২৮। রামমোহন ও গৌড়ীয় ব্যাকরণ মীর রেজাউল করিমের বিষয়। উইলিয়াম কেরির গ্রামার ১৮০১ সালে লেখা হয়, এই প্রবন্ধে সালটি ১৯০১ বলে উল্লেখ আছে। রামমোহন বিলেতযাত্রার আগে গৌড়ীয় ব্যাকরণের খসড়া পাণ্ডুলিপিটি রেখে গিয়েছিলেন, পরে স্কুল বুক সোসাইটির অধ্যক্ষের উপর ভার দিয়েছিলেন তা পরিমার্জন করে প্রস্তুত করার জন্য। লেখাটির মধ্যে রামমোহনের সেই সময়ের থেকে এগিয়ে থাকার নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে।
একুশ শতকের চোখে রামমোহন
সম্পা: অভিজিৎকুমার ঘোষ, প্রকাশচন্দ্র সরকার
৫৫০.০০
পুস্তক বিপণি
এই সঙ্কলনে শেষ রচনা প্রকাশচন্দ্র সরকারের কলমে রামমোহনের ব্রহ্মসঙ্গীত। লেখক রামমোহন রচিত প্রার্থনাপত্রে (রচনা ১৮২৩) ব্রহ্মসঙ্গীত নামের সন্ধান পাননি সঙ্গত কারণেই, কারণ রামমোহন ১৮২৮ সালে ব্রহ্মসঙ্গীত নামে একটি ছোট পুস্তিকা রচনা করেন— হরফ প্রকাশনীর রামমোহন রচনাবলী-র ৩৪৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। এই ব্রহ্মসঙ্গীত নামটি রামমোহনের দেওয়া। এই নাম রামমোহন স্বয়ং দেন খুব সম্ভবত প্রাচীন সংস্কৃত ‘ব্রহ্মগীতি’ বা ‘ব্রহ্মগীতিকা’ নামটির অনুকরণে। রামমোহন রচিত ব্রহ্মসঙ্গীতের সংখ্যা ৩২। ১৮৮০ সালে রাজনারায়ণ বসু ও আনন্দচরণ বেদান্তবাগীশ রামমোহন গ্রন্থাবলির নির্ভরযোগ্য সংস্করণ প্রকাশ করেন। অনুমান করা যেতে পারে, রাজনারায়ণ তাঁর পিতা নন্দকিশোর বসুর (রামমোহনের বিশেষ সুহৃদ) সাহায্যে রামমোহনের গান শনাক্তকরণ ও সঙ্কলনে তাঁর পিতার সাহায্য পেয়েছিলেন। লেখকের মতে, রামমোহনের গানের অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে এবং ‘মেহগিনির মঞ্চে রাখা ব্রহ্মসংগীত সংকলন’-এ রামমোহনের গান উপেক্ষিত— এই কথাগুলো বোধ হয় সত্যি নয়।
এই বইটির একটি বিশেষ সম্পদ রামমোহন রায়ের লিখিত গ্রন্থ ও তাঁর লেখার উপর চর্চার পঞ্জি। রামমোহন রায়ের লিখিত পুস্তিকা, প্রবন্ধ, গ্রন্থপঞ্জি অন্যত্র পাওয়া গেলেও, এখানে রামমোহন রায় সম্পর্কিত ইংরেজি ও বাংলায় লিখিত ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের (দু’-একটি বাদে) দীর্ঘ তালিকা দেওয়া আছে। এই গ্রন্থের আরও একটি মূল্যবান তালিকা হল সাময়িক পত্রপত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলায় রামমোহন বিষয়ক প্রবন্ধ চর্চা। এই সকল তালিকার সঙ্কলনটির জন্য সৃজন দে সরকারের সাধুবাদ প্রাপ্য। তবে গ্রন্থের তালিকাগুলি কালানুক্রমিক হলে খুবই উপকার হত। ফারসি ভাষায় রচিত রামমোহনের তুহফাৎ-উল-মুওয়াহিদ্দীন গ্রন্থটি বাদ গেছে।
প্রুফ দেখা নিয়ে একটু যত্নবান হলে বইটি সর্বাঙ্গসুন্দর হত। সালের হিসাব ও বানানেও বেশ কয়েকটি ভুল চোখে পড়েছে।