বইটি হাতে তুললেই চোখে পড়ে রাষ্ট্রতত্ত্ব অধ্যাপক আশুতোষ ভার্শ্নির মন্তব্য, এখনকার ভারতের মুসলমান মুখগুলিকে বুঝতে সহায়ক এই বই। বইয়ের উপশিরোনামও বলে, ‘নতুন ভারত’-এ মুসলমান বৃত্তান্ত এর উপজীব্য। বইটি পড়ে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, ‘নতুন ভারত’-এর হিন্দুত্ববাদ, এমনকি গণতন্ত্রকে বুঝতেও বিশেষ সাহায্য করলেন হিলাল আহমেদ। স্বাভাবিক। সংখ্যালঘুকে এই ভারতে কেমন ভাবে দেখা হয়, সেটা তলিয়ে দেখাটা এই সময়ের ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ বুঝতেও অতি আবশ্যিক। গণতন্ত্রের গতিপ্রকৃতি বুঝতেও।
এই যেমন, ভূমিকা এবং আটটি অধ্যায় ধরে যে বিশ্লেষণ, তার উপসংহারে লেখক তাঁর যে কয়েকটি মূল যুক্তিকে ফিরিয়ে আনেন, সেগুলিকেই প্রথমে ফিরে দেখা যেতে পারে। এই যুক্তিগুলি সরাসরি ভারতীয় সংবিধানে যে কয়েকটি প্রধান নীতি পরিবেশিত— গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা, এবং সামাজিক ন্যায়— সেগুলিকে ঘিরে আলোচিত। লেখক আমাদের ফিরে ভাবতে বলেন, ‘নতুন ভারত’-এর সাম্প্রতিক অধ্যায়টিকে সাধারণ ভাবে ২০১৪ সাল থেকে সূচিত করার যে রীতি, তার মধ্যে কোনও ভুল আছে কি না। ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা, সংখ্যালঘু-বিরোধিতা, হিন্দুত্ববাদ, এর কোনওটিকেই কি কেবল ২০১৪-পরবর্তী মোদী ভারতের সঙ্গে একাত্ম করে দেখা যায়? তার আগেও কি এই প্রতিটি ধারা বহমান ছিল না, সঙ্গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে? গত এক দশকে এগুলির প্রসার ও মান্যতা অনেক বেড়ে গেলেও একটা আলাদা যুগ বলে একে যদি দেখা হয়, তবে স্বাধীন ভারতের সংখ্যালঘু সমস্যাকে হয়তো ঠিক ভাবে বোঝা যায় না। জাত ও ধর্ম, দুই দিক দিয়েই ভারতীয় রাজনীতি আগাগোড়া সঙ্কটাপন্ন ছিল। এই প্রসঙ্গে খুব জরুরি একটি কথা মনে করিয়ে দেন লেখক। ১৯৯০-এর দশকে জাত-রাজনীতির একটি নতুন দিশা মিললেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি, বরং নিম্নবর্ণ হিন্দুকে নতুন ভাবে হিন্দুত্ব-পরিসরের মধ্যে টেনে আনতে এই সময় থেকে হিন্দু ‘ভিকটিমহুড’-তত্ত্ব তথা মুসলমান-বিরোধিতাকে আরও কয়েক ধাপ বাড়ানো হয়েছিল।
উপরন্তু ২০১৪-পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ ঘটেছে, এই যুক্তিটিকেও তিনি সতর্ক ভাবে গ্রহণ করতে বলেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে দেওয়া, অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ, এগুলি নিশ্চয়ই বড় পরিবর্তন। কিন্তু সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে আগেও হিংসাত্মক কার্যক্রম হয়ে থেকেছে, এবং তার পরও গণতান্ত্রিক পরিসর যখন কমেনি— সংখ্যালঘু বিরোধিতার সঙ্গে গণতন্ত্রের অবনমনের যোগ কতটা, এই প্রশ্ন তুলেছেন লেখক। বক্তব্যটি নতুন না হলেও অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, ভারতীয় মুসলমান প্রসঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে। বিশেষত যখন গণতন্ত্র এবং অসহিষ্ণু সংখ্যাগুরুবাদ যে কতটাই সহচর হতে পারে, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা ক্রমশ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব দ্য প্রেজেন্ট: মুসলিমস ইন নিউ ইন্ডিয়া
হিলাল আহমেদ
৬৯৯.০০
পেঙ্গুইন ভাইকিং
হিলাল আহমেদের এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিছু সংশয় থাকতে পারে। কিন্তু সে কথায় আসার আগে দেখে নেওয়া ভাল, তাঁর বইয়ের যে মূল প্রতিপাদ্য, তার সঙ্গে যুক্তিগুলির সাযুজ্য কত জোরালো। তিনি জোর দিচ্ছেন ‘ডিসকোর্স মুসলিমনেস’ আর ‘সাবস্টানটিভ মুসলিমনেস’-এর যে দূরত্ব, তার উপর। ‘মুসলমান’ সত্তাকে যখন একটা ডিসকোর্স বা আলোচনার পরিসরে বোঝার চেষ্টা হয়, তখন তা হয়ে ওঠে বিমূর্ত এবং অনেকাংশে সাধারণীকৃত। অঞ্চলভেদে, গোষ্ঠীভেদে, সমাজভেদে মুসলমান জনসাধারণের অভ্যাস, জীবনযাপন, সংস্কৃতি, ভাবনাচিন্তাকে এই ভাবে একীকৃত করে দেখাটা আসলে ভয়ঙ্কর ভুল, এবং বিপজ্জনক— ঠিক যেমন ‘হিন্দু’ বলে কিছু সাধারণীকৃত ধারণা বাস্তবানুগ হতে পারে না। এই ভাবে সনাতনী ‘হিন্দু ঐতিহ্য’-এর মতোই একটা সঙ্কটজনক ধারণা হয়ে দাঁড়ায় ‘ভারতের মুসলমান’, যার মধ্যে অতীতকে একটিমাত্র খোলসের মধ্যে ভরে দেওয়ার চেষ্টা চলে। এ দেশে মুসলমান সমাজের বহুত্ব, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ধারায় অবিরত অংশগ্রহণ এবং আত্মীকরণ— ‘লিবারাল-সেকুলার বনাম হিন্দুত্ববাদ’ দ্বৈততায় সেই সব বিভিন্নতা ডুবে যেতে বসে। লিবারাল মুসলমান এর মধ্যে বাদ পড়ে যেতে বসেন, অথচ তিনি আগাগোড়া ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন, এবং আসছেন। কেউ নিজেকে মুসলমান ভাবলেই তিনি লিবারাল নন, কিংবা লিবারাল পরিসরে বিচরণ করলেই তিনি মুসলমান নন, এই ‘বাইনারি’ না ভাঙলে ভারতের সংখ্যালঘু জীবনকে বুঝতে পারা অসম্ভব, লেখক মনে করান। বলেন যে, গণতন্ত্রকে যদি কেবল ভোটের নিরিখে বিচার না করা হয়, তবে দেখা যাবে দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও গ্রহিষ্ণুতার জায়গাটা এখনও বেশ বড় মাপের। হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদের রাজনীতি সমাজকে কখনওই গ্রস্ত করতে পারেনি।
তা সত্ত্বেও মুসলমান আইডেন্টিটি সমাজের মূলস্রোতে ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ছে কেন? হিলাল আহমেদ উত্তর খুঁজছেন, হিন্দু সমাজের লিবারাল বা গ্রহিষ্ণুু অংশের মানসিক আলস্যে, যে আলস্যের কারণে মুসলমানরা ঠিক কে বা কী— তাঁরা যথার্থ ভাবে বিচার-বিবেচনা করেন না, এবং বিপক্ষের সামনে তা যথেষ্ট ভাবে তুলে ধরেন না। ঔপনিবেশিক লিবারালিজ়ম-এর ধ্যানধারণাই ভারতীয় সমাজের এই ক্ষতিটা করেছে, লেখক বলেন। মোদীর ‘নতুন ভারত’-এর মোকাবিলার জন্য তাই একটা বিকল্প ঐতিহাসিক তত্ত্ব চাই, যা ভারতীয় সহিষ্ণুতা ও গ্রহিষ্ণুতাকে ঠিক ভাবে তুলে ধরতে পারে। যোগেন্দ্র যাদবের ভারতের ‘স্বধর্ম’ ভাবনাকে এই প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি।
সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় মুসলমান প্রসঙ্গে আলোচনার একটি নতুন ধারা হল, মুসলমানদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসাবে না বিবেচনা করে, তাঁদের কেন্দ্রে নিয়ে আসা, এবং শক্তিশালী ভারতীয় মুসলিম সমাজের চেহারাটি ঠিক ভাবে তুলে ধরা। মনে পড়তে পারে অমর সোহেল-এর দ্য মুসলিম সেকুলার বইয়ের কথা। এই ধারায় আলোচ্য বইটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন, অবশ্যই। শেষ অবশ্য একটা জরুরি প্রশ্ন থেকেই যায়। ভারতীয় গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ তত্ত্ব যদি না-ও মানা হয়, তবুও ভারতে উদারবাদী ভাবধারার যে ক্রমবর্ধমান অপ্রাসঙ্গিকতা, এবং তার পিছনে যে বিশ্ব-প্রেক্ষাপট, এবং নিয়ো-লিবারাল সমাজ-অর্থনীতির আবহ— সে সব ছাড়া কি আজকের বিপন্নতর ভারতীয় মুসলমান সমাজকে বোঝা সম্ভব? সংখ্যালঘু-বিরোধিতা আগেকার ভারতে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করেনি বলেই যে বর্তমানে বা ভবিষ্যতে করবে না, এও কি জোর দিয়ে বলা যায়— যখন বিশ্বময় দক্ষিণপন্থা ও নব্য-ধনতন্ত্রের দাপট এখন ক্রমশই অনেক বেশি এবং অনেক বড়?
আসলে, যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, এই বই জরুরি কেবল ‘নতুন ভারত’-এর ‘মুসলমান সমস্যা’ বোঝার জন্যই নয়, ‘নতুন ভারত’কে বোঝার জন্যও বটে। এবং সেই কারণে, এই অস্বস্তি হয়তো বইয়ের শেষে পাঠক-মনে বিঁধেই থাকে কাঁটার মতো