বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে: সনজীদা খাতুন সম্মাননা-স্মারক
সম্পাদক: আবুল আহসান চৌধুরী, পিয়াস মজিদ
৭০০.০০
শোভাপ্রকাশ, ঢাকা
সনজীদা খাতুনের লেখার এক বড় অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। আজকের বাংলাদেশ আর প্রাক্-একাত্তর পাকিস্তান-পর্বে রবীন্দ্রনাথকে ব্যাপক পরিসরে জনমানসে পৌঁছে দেওয়ার কাজে ঐতিহাসিক ভূমিকায় ছিলেন তিনি। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সনজীদা এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় কীর্তি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’, যা কিছু কাল আগে ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় সম্মানেও ভূষিত। তবে শুরুর দিকে সম্মান ও স্বীকৃতির চেয়ে আঘাত ও বিরোধিতাই ছিল প্রবল। পূর্ববাংলায় গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রাসী সাংস্কৃতিক নীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্র-নজরুল এবং আবহমান বাংলার মানবতাবাদী-সমন্বয়ী ভাবধারাকে আশ্রয় করে ‘ছায়ানট’ ঢাকার রমনার বটমূলে শুরু করে বাংলা বর্ষবরণ আয়োজন।
শুধু ছায়ানট তো নয়, ‘জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ’, ‘ব্রতচারী আন্দোলন’, আবৃত্তিচর্চার সঙ্ঘ ‘কণ্ঠশীলন’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা— সব জায়গাতেই সনজীদা খাতুনের উদ্ভাবনময়তা, শ্রম, মেধা ও মনীষার ছাপ। তিনি শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। কলকাতা থেকে তাঁর একাধিক বই এবং গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে বহু আগেই। একাত্তরের কলকাতাবাসে তিনি ‘রূপান্তরের গান’ এবং ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র হয়ে সাংস্কৃতিক লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।
সনজীদা খাতুনের ৮৭ বছরের জন্মদিন উপলক্ষে আবুল আহসান চৌধুরী ও পিয়াস মজিদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হল বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে: সনজীদা খাতুন সম্মাননা-স্মারক গ্রন্থটি। আটটি বিভাগে প্রায় ৬০ জনের লেখা সনজীদার জীবনের নানা দিক। অগ্রজের অভিনন্দন-লেখনের সঙ্গে আছে তাঁর স্বপ্ন ও সংগ্রামের নিগূঢ় বিশ্লেষণ। গায়কসত্তার পাশাপাশি শিক্ষক হিসেবে অনন্যতা আলোচিত হয়েছে। আছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বইগুলির আলোচনা। প্রিয় বন্ধু স্বপ্না দেবের সঙ্গে একটি কৌতূহলোদ্দীপক পত্রালাপ এবং তাঁর প্রামাণ্য জীবনী ও গ্রন্থপঞ্জি আছে।
লেখকদের মধ্যে আছেন সদ্যপ্রয়াত তিন বিশিষ্ট জন—আনিসুজ্জামান, দেবেশ রায় ও অরুণ সেন। আছেন শঙ্খ ঘোষ, হাসান আজিজুল হক, সরদার ফজলুল করিম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সুধীর চক্রবর্তী, গোলাম মুরশিদ, হায়াৎ মামুদ, সেলিনা হোসেন, সুতপা ভট্টাচার্য, মতিউর রহমান, হুমায়ুন আজাদ, আবুল হাসনাত, মফিদুল হক, দাউদ হায়দার, সুভাষ চৌধুরী, সমীর সেনগুপ্ত, ইফফাত আরা দেওয়ান, শান্তা সেন, বিশ্বজিৎ ঘোষ প্রমুখ।
শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, “গান তাঁর জীবিকা নয়, গান তাঁর জীবন, চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে মিশে যাওয়া এক জীবন। ধর্মতলা স্ট্রিটের প্রথম পরিচয়ে জেনেছিলাম যে দেশের আত্মপরিচয় খুঁজছেন তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে, আর আজ জানি যে সে-গানে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজেরই আত্মপরিচয়।”
দেবেশ রায় সনজীদার কণ্ঠে গান শোনার প্রসঙ্গে লিখেছেন, “সনজীদা দুই বাংলারই সেই বিরলতম গায়িকা, যিনি গান না গাইলেও শুধু মননচর্চার সুবাদেই মান্য হয়ে থাকতেন।” আনিসুজ্জামানের ভাষায়, “তাঁকে অভিনন্দন এক সৃজনশীল জীবন যাপনের জন্য। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কীর্তির মধ্যে, তাঁর অনুরাগীদের ভালোবাসায়। জয় হোক তাঁর।”