হিকি সাহেবের গেজেট
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
৪০০.০০
দে’জ
শুধুমাত্র ভারত-দর্শনের জন্য সাগর পাড়ি দিয়ে কলকাতায় পৌঁছেছিলেন এক আইরিশ ভদ্রলোক। ১৭৭২ সালে ডিসেম্বরে জাহাজ নোঙর করেছিল চাঁদপাল ঘাটে। উনিশ শতকের গোড়ায় ভগ্নমনোরথে সর্বস্ব হারিয়ে যখন ফের বিলেতের উদ্দেশে পাড়ি দিলেন, তত দিনে কেটে গিয়েছে প্রায় ত্রিশ বছর। নাম তাঁর জেমস অগস্টাস হিকি— ‘দ্য পাপা অব ইন্ডিয়ান প্রেস’।
এ শহর বড় নিষ্ঠুর। চোখের পলকে খ্যাতির চুড়ো নামিয়ে আনে। চরম দারিদ্রে প্রাসাদতুল্য বাড়ি ছেড়ে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঝুপড়িতে বাস করতে বাধ্য হন হিকি। ব্রিটিশ শাসনের সমালোচনা প্রকাশিত হওয়ায় সরকারি হস্তক্ষেপে পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দিন-রাত ‘বেঙ্গল গেজ়েট’-এর পুনঃপ্রকাশের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে, সর্বস্বের বিনিময়ে আরও ক’বছর চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু প্রেস চালানোর পুঁজির জোগান নেই। পাঠক সংখ্যা বাড়তে থাকায় পত্রিকার সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। সংবাদপত্র যে জনসংযোগের অপরিহার্য অঙ্গ, সে কথা বুঝছে সবাই। তবু সরকারি নিষেধাজ্ঞার ভয়ে সরকারের বিপক্ষে কথা বলে না কেউ। এক তরফা লড়াই চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন ‘ফাদার অব ইন্ডিয়ান জার্নালিজ়ম’। সরকারবিরোধী তকমা জোটায় অন্য পত্রিকার দফতরেও কাজ মেলে না। বয়সের ছাপ পড়ে শরীরে। এক সময় সরকারের সঙ্গে ন্যায্য পাওনা নিয়ে লড়াই করা হিকি বিস্তর চিঠি চালাচালির শেষে সরকারের শর্তেই অর্ধেকেরও কম বকেয়া টাকা মেটানোর প্রস্তাবে রাজি হন। দেশে ফেরার আগে মাত্র দু’হাজার টাকায় বেচে দেন প্রেসের সামগ্রী। যে মানুষটি মাত্র কয়েকশো পাউন্ড সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসে নিজের যোগ্যতায় আলাদা পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন, ফিরতি জাহাজে খরচ চালানোর জন্যে সার্জনমেট হতে হয়েছিল সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধকে। পরিবারের সবাই আগে দেশে ফিরে গেলেও তিনি পারেননি। সমুদ্রপথেই তাঁর মৃত্যু হয়।
এই জীবন-কাহিনি অবলম্বনেই রচিত আলোচ্য বইটি। শুধু হিকি নন, উপন্যাসে লেখক ধরতে চেয়েছেন আঠারো শতকের বাংলাকে। শোভা সিংহের বিদ্রোহ, অন্ধকূপ হত্যা, পলাশির যুদ্ধ, মন্বন্তর, কোম্পানির দেওয়ানি লাভ প্রভৃতি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে আছে গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, সতীদাহও। আছেন ওয়ারেন হেস্টিংস, এলিজা ইম্প, নবকৃষ্ণ মিত্র, চূড়ামণি দত্ত, কৃষ্ণকান্ত নন্দী। কাহিনির প্রয়োজনে আবির্ভাব ঘটেছে বাঙালি যুবক চন্দ্রমোহন ও তার বোন ইন্দুর। হিকির গেজ়েটের মধ্য দিয়ে সাহেবদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে, চন্দ্রমোহনের চোখে ধরা পড়ে নেটিভদের ঘরের কথা। হিকি ও কাগজ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় উপাদানের স্বল্পতা সত্ত্বেও লেখকের উদ্যোগ প্রশংসনীয়, কেননা তিনি সামগ্রিক ভাবে একটা শতকের ছবি তুলে ধরেছেন। তবে এটা উপন্যাসের প্রধান দুর্বলতাও। ইতিহাসের সঙ্গে সাহিত্যের চাপানউতোরে বেশির ভাগ সময়ে ইতিহাসের পাল্লা ভারী। অনাবশ্যক ঘটনাবলি, বড়লোকেদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের বিস্তারিত বর্ণনা কাহিনির মেদ বৃদ্ধি ঘটেছে। বরং, চিকিৎসা সূত্রে হিকি যে ভাবে নেটিভদের সংস্পর্শে এসে তাদের পৃথিবীর অন্য সুরটি আবিষ্কার করেছিলেন, সে সম্পর্কে আরও কিছু শব্দ ব্যয় করলে উপন্যাসটির সামাজিক মূল্য বৃদ্ধি পেত। ‘বেঙ্গল গেজ়েট’-এ প্রকাশিত আরও কিছু খবরের উল্লেখও অপ্রাসঙ্গিক হত না।
ইতিহাসের অজস্র অবতারণা থাকলেও মুদ্রণপ্রমাদের দৌলতে তা পাঠককে বিভ্রান্ত করে। কলকাতায় জোব চার্নকের তৃতীয় বার আগমনের তারিখ ১৪ অগস্ট ১৬৯০ (পৃ ১৯৩), পরের পাতায় অন্য তারিখ, যেটি ঠিক। সাইমন ড্রোজ (পৃ ২৪৮) কখনও ড্রুজ (পৃ ২৪৯), কখনও দ্রুজ (পৃ ২৭৮)। রোহিলা-কে লেখা হয়েছে ‘রোহিঙ্গা’ (পৃ ৩৩৪)! খাপছাড়া লাগে নিজের যোগ্যতা বোঝাতে হিকির ‘ক্যালি’ (পৃ ১৮০) শব্দের ব্যবহার। আখ্যানেও পারম্পর্যের অভাব লক্ষণীয়। মহারাজা নন্দকুমার প্রসঙ্গে ‘প্রথম ভারতীয় শহিদ’ অভিধাও বিতর্কিত।
ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাসটির ক্ষতি করেছে এহেন ভ্রমের সমাবেশ ।