দ্রৌপদীকে কৃষ্ণের অক্ষয় পাত্রের মহিমা বর্ণন। বামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় অঙ্কিত চোরবাগান আর্ট গ্যালারির ছবি। সূত্র: উইকিপিডিয়া
মহাভারতে বর্ণিত কাহিনি অনুসারে পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে পাণ্ডবরা বনগমন করলে অগণিত ব্রাহ্মণ ও মুনি-ঋষি তাঁদের সঙ্গ নেন। এতে যুধিষ্ঠির পড়েন মহা বিপাকে। তাঁরা সব কিছু ত্যাগ করে বনবাসী হয়েছেন। কিন্তু রাজধর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ ও অতিথির সেবা একান্ত কর্তব্য। কী করে তিনি তাঁদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সাক্ষাৎ করতে আসা অতিথিদের সেবা করবেন, এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে পুরোহিত ধৌম্যের শরণাপন্ন হন যুধিষ্ঠির। ধৌম্য তাঁকে সূর্যের আরাধনা করতে বলেন এবং আরাধনার পদ্ধতিও শিখিয়ে দেন।
ধৌম্যের কথা মতো যুধিষ্ঠির সূর্যদেবের পুজা করলেন। সূর্য তুষ্ট হয়ে তাঁকে এক তামার পাত্র দান করলেন এবং বললেন, “বনবাসের দ্বাদশ বৎসর এই তাম্রস্থালীই তোমাদের অন্ন দেবে। সকলের আহার শেষ হলে যতক্ষণ না পর্যন্ত দ্রৌপদী আহার করছেন, ততক্ষণ এই পাত্রের আহার্য ফুরবে না।” সূর্যের কাছ থেকে সেই পাত্র লাভ করে যুধিষ্ঠির নিশ্চিন্ত মনে বনবাসী হয়ে সাধুসঙ্গ ও অতিথি সেবা করতে লাগলেন। সূর্যের দেওয়া পাত্রের কথা কৌরবদেরও কানে পৌঁছল। তাঁরা পাণ্ডবদের পর্যুদস্ত করার নানা উপায় খুঁজছিলেন। এমতাবস্থায় মহাতেজা, মহাক্রোধী তপস্বী দুর্বাসা দুর্যোধনের আতিথ্য স্বীকার করলেন। সঙ্গে ১০ হাজার শিষ্য। দুর্বাসা কখনও কৌরবদের বলতেন যে, তিনি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। স্নান সেরে আসছেন। কৌরবরা যেন তাঁদের আহার প্রস্তুত রাখেন। কিন্তু অনেক সময়েই স্নান করতে গিয়ে প্রচুর দেরি করতেন। ফিরে এসে বলতেন, খিদে নেই। কখনও মধ্যরাত্রে উঠে অন্নপাক করতে বলতেন। ব্যপারটা বুঝে দুর্যোধন ঠিক করলেন, দুর্বাসাকে সশিষ্য বনবাসী পাণ্ডবদের কাছে পাঠালে তাঁরা জব্দ হবেন। কিন্তু সূর্যপ্রদত্ত তাম্রস্থালির গুণে অনন্ত অতিথি সেবা পাণ্ডবদের কাছে কোনও সমস্যার বিষয়ই নয়। তখন শকুনির পরামর্শে তিনি দুর্বাসাকে বললেন, পাঞ্চালীর ভোজন হয়ে যাওয়ার পর অপরাহ্নে তিনি যেন পাণ্ডবদের আতিথ্য গ্রহণ করে আহার্য চান। দুর্বাসা তাতে রাজি হয়ে বনবাসী পাণ্ডবদের কাছে শিষ্যদের নিয়ে উপস্থিত হন। পাণ্ডব ও দ্রৌপদী— সকলেরই তখন মধ্যাহ্নভোজন হয়ে গিয়েছে। সূর্যপ্রদত্ত তাম্রপাত্র শূন্য। দুর্বাসা বললেন, তিনি স্নান সেরে আসছেন। ফিরে ন আহার্য পান।
পাঞ্চালী পড়লেন মহা বিপদে। উগ্রতেজা মুনিকে তুষ্ট করতে না পারলে পাণ্ডবরা ভস্ম হয়ে যেতে পারেন। উপায়ান্তর না দেখে তিনি তাঁর প্রিয় সখা শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করলেন। কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন, তিনি নিজেই দারুণ ক্ষুধার্ত। কৃষ্ণা যেন তখনই তাঁর আহারের ব্যবস্থা করেন। পাঞ্চালী জানালেন, সব আহার্য নিঃশেষিত। তাম্রপাত্র শূন্য। কৃষ্ণ বললেন পাত্র খুঁটিয়ে দেখতে। কিছু না কিছু তাতে লেগে থাকবেই। দ্রৌপদী পাত্রটি নিয়ে এলে কৃষ্ণ দেখলেন, তার কানায় সামান্য শাকান্ন লেগে রয়েছে। তিনি সেটুকুই খেয়ে বললেন, “বিশ্বাত্মা যজ্ঞভোজী দেব তৃপ্তিলাভ করুন। তুষ্ট হন।” তার পর সহদেবকে বললেন, দুর্বাসাদের ভোজনের জন্য ডেকে আনতে। দুর্বাসাদের আহ্নিক তখনও শেষ হয়নি। কিন্তু তাঁরা টের পেলেন, উদর পরিপূর্ণ। তাঁদের ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়েছে। শিষ্যরা দুর্বাসাকে জানালেন, আর আহার করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। দুর্বাসা প্রমাদ গণলেন। তিনি ভাবলেন এখন যদি পাণ্ডবদের কাছে গিয়ে তিনি আহার্য অস্বীকার করেন, তবে তো মহা অকল্যাণ ঘটতে পারে। পাণ্ডবরা হরিচরণে আশ্রিত। তিনি সশিষ্য পলায়ন করলেন। ওদিকে পান্ডবরাও দুর্বসার সশিষ্য পলায়নের বৃত্তান্ত জানতে পেরে নিশ্চিন্ত বোধ করলেন।
সূর্যপ্রদত্ত তাম্রপাত্রকে যে দিন অক্ষয়পাত্রে পরিণত করেছিলেন কৃষ্ণ, পৌরাণিক কাল থেকে মনে করা হয় সেই দিনটিই ছিল অক্ষয় তৃতীয়া।
‘দ্রৌপদীর হাঁড়ি’ সারা ভারতেই অক্ষয় স্বাচ্ছল্যের প্রতীক। এর পিছনে কি কোথাও রয়ে গিয়েছে সূর্যের অনিঃশেষ দানে ভরে ওঠা ধরিত্রীর অক্ষয় শস্যে পূর্ণ হয়ে ওঠার আবর্তনের বৃত্তান্ত? সে ভাবনা ভাববেন সমাজ-নৃতত্ত্বের তাত্ত্বিকরা। এ মহা ভারতের আপামর মানুষ যুগ যুগ ধরে এই কাহিনিতে পেয়েছেন বেঁচে থাকার প্রেরণা। দুর্ভিক্ষের পর দুর্ভিক্ষ পেরিয়েছে এই কাহিনি। মানুষ আশায় বেঁচেছে। প্রকৃতির অক্ষয় পাত্রের প্রতি তার বিশ্বাস তাকে যে কোনও মারি অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে।