গঙ্গাবতরণ, রাজা রবি বর্মার তুলিতে। সূত্র: উইকিপিডিয়া
হিন্দু বিশ্বাসে গঙ্গা ভারতের পবিত্র নদীগুলির মধ্যে প্রধান। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পুরাণ মতে গঙ্গা এই বিশ্বের নদীই নয়। গঙ্গা আসলে ব্রহ্মার মানসকন্যা এবং স্বর্গেই প্রবাহিতা ছিলেন। এক বিশেষ কারণে তাঁকে মর্ত্যে নেমে আসতে হয়। যে দিন তিনি মর্ত্যে অবতরণ করেন, সেই দিনটি ছিল অক্ষয় তৃতীয়া। এমন বিশ্বাস বেশ কিছু পুরাণে লভ্য। পাশাপাশি অন্যত্র এ-ও বলা হয়, গঙ্গাবতরণ ঘটেছিল জ্যৈষ্ঠ মাসে।
এই বিতর্কের মধ্যে ঢুকতে গেলে আগে জানা দরকার গঙ্গার মর্ত্যে অবতরণের কাহিনি।
মহাভারতের বনপর্বে লোমশ মুনি যধিষ্ঠিরকে গঙ্গাবতরণের আখ্যান জানিয়েছিলেন। ইক্ষ্বাকু বংশের রাজা সগর ছিলেন অপুত্রক। পুত্রকামনায় তিনি তাঁর দুই পত্নীর সঙ্গে কৈলাস পর্বতে গিয়ে কঠোর তপস্যা করে মহাদেবের বরলাভে সমর্থ হন। এর ফলে তাঁর এক স্ত্রী-র গর্ভে ৬০ হাজার ও অন্য জনের গর্ভে একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। বেশ কিছুকাল পরে সগর অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। যজ্ঞের ঘোড়াটি ৬০ হাজার সগরপুত্রের দ্বারা রক্ষিত হতে হতে সমুদ্রের তীরে এসে উধাও হয়ে যায়। সমুদ্রবাসী অসুর, নাগ এবং রাক্ষসরা তাকে অপহরণ করেছে ধরে নিয়ে সগরপুত্ররা সমুদ্র খনন করে নাগ-অসুর-রাক্ষসদের নির্বিচারে হত্যা করে পাতালে পৌঁছন। সেখানে তাঁরা দেখতে পান, এক মহাতেজা ঋষি ধ্যানমগ্ন। ইনিই কপিলমুনি। তাঁর সামনেই ঘোড়াটিও বিচরণ করছিল। কপিলকে অশ্বচোর ভেবে সগরপুত্ররা আক্রমণ করতে উদ্যত হলে কপিল তাঁর দৃষ্টি দ্বারা তাঁদের ভস্ম করেন।
সগরের বংশে বাতি দিতে বেঁচে রইলেন তাঁর দ্বিতীয়া কন্যার গর্ভজাত পুত্র অসমঞ্জা। কিন্তু অসমঞ্জা ছিলেন পাপাচারী। সগর তাঁকে নির্বাসন দেন। অসমঞ্জার পুত্র অংশুমানকে সগর তাঁর ৬০ হাজার পুত্রের করুণ পরিণতি শোনালে অংশুমান পূর্বপুরুষদের উদ্ধারে ব্রতী হন। তিনি পাতালে গিয়ে কপিলমুনির কাছে ক্ষমা চান এবং যজ্ঞাশ্ব ও পূর্বপুরুষদের মুক্তি প্রার্থনা করেন। কপিল তাঁকে অশ্ব ফিরিয়ে দেন এবং জানান, অংশুমানের পৌত্র মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে নিয়ে এলেই তাঁর পূর্বপুরুষরা মুক্তি পাবেন। অংশুমানের পুত্র দিলীপ এবং দিলীপের পুত্র ভগীরথ। রাজ্যলাভের পর ভগীরথ তাঁর মন্ত্রীদের উপরে রাজ্যভার অর্পণ করে হিমালয়ে গিয়ে গঙ্গার আরাধনা শুরু করেন। সহস্র বছর ধরে চলে এই তপস্যা। অবশেষে গঙ্গা মূর্তিমতী হয়ে ভগীরথকে দেখা দেন এবং জানান, তিনি মর্ত্যে অবতরণ করতে সম্মত। কিন্তু তাঁর মতো বেগবতীকে মর্ত্যে প্রবাহিত করতে হলে বেগ স্তিমিত করা প্রয়োজন। একমাত্র মহাদেবই সেই কাজে সমর্থ।
এর পর ভগীরথ কৈলাসে গিয়ে কঠোর তপস্যায় মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেন। চন্দ্রচূড় তাঁর জটাজালে জাহ্নবীকে ধারণ করতে সম্মত হন। অবশেষে গঙ্গা স্বর্গ থেকে অবতরণ করলেন। মহাদেব তাঁর জটায় গঙ্গাকে ধারণ করে ধরায় প্রবাহিত হওয়ার গতিছন্দ নির্ধারণ করে দিলেন। ভগীরথ তাঁকে পথ দেখিয়ে তাঁর পূর্বপুরুষের ভস্মরাশির কাছে নিয়ে গেলেন। গঙ্গার স্পর্শে ৬০ হাজার সগরসন্তান উদ্ধার লাভ করলেন।
গঙ্গাবতরণের ওই দিনটি কি অক্ষয় তৃতীয়াই ছিল? অনেক কিংবদন্তি আবার জানায়, গঙ্গাবতরণ ঘটেছিল জ্যৈষ্ঠ মাসে। মনে রাখতে হবে, গঙ্গা সরাসরি স্বর্গ থেকে নামেননি। তাঁকে প্রথমে নামতে হয়েছিল মহাদেবের জটায়। তার পর গতি সংবরণ করে তিনি ধরায় আসেন। সে ক্ষেত্রে যুক্তিসম্মত অনুমান, অক্ষয় তৃতীয়ার দিনই মহাদেব তাঁকে জটায় ধারণ করেন এবং জ্যৈষ্ঠে তিনি সেই জটা থেকে নেমে আসেন। এখনও ভারতের বিভিন্ন স্থানে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন গঙ্গাস্নানের রীতি বিদ্যমান। হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র চার ধামের মধ্যে গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী মন্দির শীতের শেষে এই তিথিতেই পুনরায় উন্মুক্ত হয়।