মাস্ক এখন আম আদমির নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী— ফাইল চিত্র।
‘পৌষমাস’ বললে কি বাড়াবাড়ি হবে? বোধহয় না।
করোনাভাইরাসের অভিঘাত ২০২০ সালে বিশ্বজোড়া ‘সর্বনাশ’ ডেকে এনেছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে খুলে দিয়েছে নতুন সম্ভাবনার একাধিক দরজা। তৈরি হয়েছে নতুন ব্যবসার পরিসর। কোভিড-১৯ আবহে চাকরি হারানো তরুণ থেকে শুরু করে বহুজাতিক ‘সুপার কর্পোরেট’ কর্তারাও সামিল হয়েছেন সেই প্রবাহে।
করোনার সংক্রমণ তখনও এমন ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি। মে মাসের শেষ পর্বে ‘হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ’ পূর্বাভাস দিয়েছিল, মারণ ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে পেশার জগতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসতে চলেছে। সবচেয়ে বেশি ওলটপালট হবে ব্যবসার জগতে। সঙ্গে ভরসা জুগিয়েছিল— পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিখে গেলে আগামী বেশ কয়েকটা বছর নিশ্চিন্তে থাকা যাবে।
২০২০ সাল দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পাশাপাশি পেশাগত জগতে নিয়ে এসেছে ঝুঁকি এবং প্রতিবন্ধকতা। তা এড়াতে তৈরি হয়েছে নতুন পণ্য ও পেশা। মাস্ক-স্যানিটাইজার এখন আম আদমির নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। গ্লাভসের চাহিদা বেড়েছে বিপুল। তার জোগান দিতে গড়ে উঠেছে নতুন নানা ক্ষুদ্রশিল্প উদ্যোগ। অনেকে আবার পুরনো পেশাকে সামান্য বদলে নিয়ে সময়োপযোগী করেছেন। গলির মোড়ের পরিচিত দর্জি এখন দিনভর কাপড়ের মাস্ক বানানোয় ব্যস্ত। পাড়ার ফিনাইল কারখানায় কারিগরদের দম ফেলার ফুরসত নেই। স্যানিটাইজারের বরাত বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। করোনা-পরবর্তী সময়ে গোটা বিশ্বজুড়ে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার ব্যবসার রমরমা। সঙ্গে প্রোটেকটিভ ফেস শিল্ড, পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইক্যুইপমেন্ট (পিপিই), মেডিক্যাল প্রোটেকটিভ গগল্স, মেডিক্যাল প্রোটেকটিভ শ্যু কভার! শুধু ছোট ব্যবসায়ী নন, বিশ্ববিখ্যাত ক্রীড়াসরঞ্জাম নির্মাতা সংস্থাগুলি এনেছে ‘ব্র্যান্ডেড মাস্ক’। তরুণ প্রজন্মের নতুন ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।
আনলক পর্বে জোয়ার এসেছে স্যানিটাইজেশন ব্যবসায়— ফাইল চিত্র
ন’মাস আগে পাল্স অক্সিমিটারের নাম না-শোনা আমজনতা সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করে ঘরে সেটি মজুত করেছে। দেহে অক্সিজেনের মাত্রা মাপার সেই যন্ত্রের বেশিরভাগই আবার চিন থেকে আমদানি! শুধু ভারত নয়, অতিমারির কারণে এশিয়া-ইউরোপের বহু দেশে করোনা টেস্টিং কিট আর ভেন্টিলেটর রফতানি করছে চিন। মারণ ভাইরাসকে পুঁজি করার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু তার কোনও প্রভাব বেজিং-ব্যবসায় পড়েনি।
মন্দাক্রান্ত অর্থনীতির কারণে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের ‘সৌজন্যে’ জোয়ার এসেছে পরিচ্ছন্নতা এবং জীবাণুমুক্তকরণ সংক্রান্ত ব্যবসায়। গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে নিয়োগ করতে হচ্ছে নতুন নতুন প্রশিক্ষিত কর্মী। ফি হপ্তায় এক-দু’বার নানা অফিস থেকে স্যানিটাইজের বরাত মিলছে। কর্মস্থলে যাতায়াতের পথে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে গাড়ি জীবাণুমুক্ত করছেন অনেকে। লেনদেনের নিরিখে অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে টেক্কা দেওয়ার জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে ‘কলম্বাস ক্লিনিং সলিউশন’ বা ‘ওয়াই ক্লিনিং’-এর মতো প্রতিষ্ঠান।
কর্মী নিয়োগের জোয়ার এসেছে বিভিন্ন অনলাইন বিপণন সংস্থাগুলিতেও। লকডাউন-পর্ব অনেকটা কেটে গেলেও ভিড়ের দোকান-বাজারের এড়াতে চাইছেন অনেকে। ফলে ডেলিভারি কর্মীর প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। বেড়েছে বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট এবং অনলাইন স্টোরের ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক সামলানোর কর্মীর চাহিদা। শুধু বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়, ছোট অনেক সংস্থাও এই পণ্য পরিবহণ পরিষেবার কাজে জড়িত হয়েছে ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে।
ভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্ক অন্তরায় হয়েছে ডাক্তার-রোগী যোগাযোগের পথে। হাসপাতাল-নার্সিংহোম-চেম্বারমুখো হতে চাইছেন না অনেকে। ফলে নির্ভরতা বাড়ছে টেলিমেডিসিন পরিষেবার উপর। বিশ্বজুড়ে টেলিমেডিসিন পরিষেবা বেড়েছে কয়েক গুণ। উপকৃত হচ্ছে ওই ব্যবসায় জড়িত সংস্থাগুলি।
ডেলিভারি কর্মীর চাহিদা বাড়িয়েছে করোনা আবহ— ফাইল চিত্র
করোনা আবহ আমূল বদলে দিয়েছে পরিবহণের মাধ্যম। গণপরিবহণ এড়াতে অনেকে বেছে নিচ্ছেন সাইকেল এবং মোটরবাইক। যে কারণে সাইকেল-মোটরবাইক উৎপাদনকারী সংস্থা এবং ব্যবসায়ীরা তার সুফল পাচ্ছেন। ভবিষ্যতে লকডাউন পরিস্থিতি আঁচ করে অনেকে বাড়িতে বেশি খাবার মজুত রাখতে চাইছেন। বাড়ছে রেফ্রিজারেটরের চাহিদা। আবার নয়া ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ সংস্কৃতি ডেস্কটপ, ল্যাপটপের বিক্রি বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
লকডাউন পর্বে ঘরে বসে সিনেমা আর ওয়েব সিরিজ দেখার অভ্যেস তৈরি হয়েছে। ফলে অনলাইন মুভি স্ট্রিমিংয়ের ব্যবসা এখন জমজমাট। ভারত-সহ অনেক দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি এখনও বন্ধ। ফলে শিক্ষামূলক আর বিনোদন সংক্রান্ত অ্যাপগুলির চাহিদা কমেনি। ইন্টারনেট গেমস এবং পাজ্ল-এর জনপ্রিয়তা বাড়ায় বেড়েছে ব্যবসা। এমনকি, করোনা-পরবর্তী কালে মানুষের বই পড়ার অভ্যেস বেড়ে গিয়েছে ইউরোপ-আমেরিকায়। ঝোঁক এসেছে শরীরচর্চার। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি লাভবান হয়েছে।
পৌষমাস আর সর্বনাশ। উল্টো অর্ডারে। সর্বনাশ আর পৌষমাস।