এই বাজেট কেমন?
বাজেট পড়ার একটাই নিয়ম। সরকার কী করতে চেয়েছে আর কী করতে পেরেছে। তাও অবশ্য নির্ভর করে বাজেটে আমরা কী আশা করেছিলাম আর কী পেলাম। শেষে গিয়ে অবশ্য অঙ্কটা মিলেই যায়। কিন্তু চটজলদি আলোচনায় সমস্যা হল, সমুদ্রের মতো বিশাল বাজেট-তথ্য থেকে আলোচনার সূচক হিসাব সংখ্যা বেছে নেওয়া। আর তার বিপদটা হল যে কোথাও গিয়ে ভ্রান্তির একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়।
আমরা ইতিমধ্যেই অবশ্য জেনে গিয়েছি যে অর্থমন্ত্রী নানান প্রকল্পের মধ্যে দিয়ে কর্মসংস্থান তৈরি করতে চাইছেন। চাইছেন তার গতি বাড়াতে। পাশাপাশি, সামাজিক ও অন্য পরিকাঠামোর প্রসার ঘটিয়ে নাগরিকের জীবনের মানই শুধু নয়, মানোন্নয়নের সুযোগ এবং অধিকার বাড়ানোর প্রয়াসের কথাও বলেছেন। যেমন গতিশক্তি প্রকল্প। আগামী কয়েক বছরে এই প্রকল্পে ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থান করতে চান তাঁরা। পাশাপাশি, প্রত্যন্ত গ্রামেও ডিজিটাল সংযোগের ব্যবস্থা এমন জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছেন যাতে শহর ও গ্রামের মধ্যে অন্তত এই পরিষেবার সুযোগের কোনও ফারাক না থাকে।
আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব যা হয়ত অনেকের কানই এড়িয়ে গিয়েছে তা হল অনলাইন জমির রেকর্ড নাগরিকের নিজের ভাষায় পাওয়ার সুযোগ। এটি অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ, সাধারণ মানুষ তার জমির হিসাব নিজেরা পড়ে বুঝে উঠতে পারেন না। মাথায় রাখতে হবে এই পদক্ষেপ খুব একটা সহজ নয়। কম্পিউটারে ভারতীয় ভাষায় লেখার সুবিধার ইতিহাসই তুলনামূলক ভাবে নতুন। আর ইংরাজি ভাষায় লেখা তথ্যকে যন্ত্র দিয়ে সঠিক ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করানোর প্রচেষ্টা কিন্তু শুরু হয়েছে সদ্য।
ডিজিটাল নির্ভরতা আরও বাড়ছে। এ বছরই আসবে ডিজিটাল টাকা। তার ব্যবহার এবং চল কী হবে তা নিয়ে এখনও নির্দিষ্ট তথ্য হাতে নেই। তবে মাথায় রাখতে হবে এই রাস্তায় অনেক দেশই হাঁটার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও এখনও তা তার শৈশবেই।
কিন্তু যা বলা হয় তা সব সময়ই হয়ে ওঠে না। বিলগ্নিকরনের যা লক্ষ্য ছিল তার ৮ শতাংশও হয়ে ওঠেনি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই লক্ষ্য এবং যা হয়েছে তার মধ্যে ফারাক থেকে গিয়েছে। এ রকম নয় যে তা এই প্রথম। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রে ইচ্ছা আর করে উঠতে পারার মধ্যে ফারাক আগামীতে আমাদের বেগ দিতে পারে।
গত কয়েক বছর ধরে দেশে নাগরিকের আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। বাড়ছে শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্যও। বাড়ছে স্বাস্থ্যের অধিকারের বৈষম্যও। অন্তত কোভিডের সময় কেন্দ্রের প্রকাশিত উদ্বেগ এবং নাগরিকের অবস্থা নিয়ে দুশ্চিন্তার দাবির প্রেক্ষিতে আশা করা গিয়েছিল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে খরচ অন্তত তুল্যমূল্য ভাবে বেড়ে বিভেদ কমানোর প্রচেষ্টার প্রতিফলন করবে।
কিন্তু বাজেটের খরচের হিসাবে দেখছি ২০২১-২২-এর বাজেটে শিক্ষা খাতে খরচ ধরা হয়েছিল ৯৩ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। কিন্তু বছর শেষে পরিবর্তিত হিসাবে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ২ কোটি টাকায়। তার মধ্যে শিক্ষায় রাজস্ব খাতে খরচ ধরা ছিল ৩২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। বছর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকায়। রাজস্ব খাতে যে খরচ কমবে না তা বলাই বাহুল্য। কারণ এই খরচ সেই খাতের যা মাইনে ইত্যাদিতে খরচ হয়। তা হলে বড় কোপটা পড়েছে শিক্ষা পরিকাঠামো তৈরির খরচে! অথচ আয় বৈষম্য কমাতে সাধারণ নাগরিকের কর্মদক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। তার জন্য দরকার পরিকাঠামোর প্রসার। আর কোপ সেখানেই।
অর্থমন্ত্রী বাজেট পেশ করাকালীন কিন্তু বক্তৃতা থামিয়ে জানুয়ারি মাসে ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি রেকর্ড জিএসটি সংগ্রহের কথা ঘোষণা করতে দ্বিধা করেননি। অথচ তাঁর আর্থিক নীতির ব্যাখ্যায় কোথাও বৈষম্যের যেমন উল্লেখ নেই তেমনই ব্যাখ্যা নেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে লক্ষ্য মেটানোয় কেন খামতি থেকে গিয়েছে তার।
বাজেটের বাকি অঙ্ক না দেখে আরও বিস্তারে যাওয়া মুশকিল কিন্তু এখনও পর্যন্ত যেটুকু দেখা গিয়েছে তাতে আবারও বলতে হয়, কর ব্যবস্থায় বা তার হারে বিরাট কোনও পরিবর্তনের উল্লেখ এই বাজেটে নেই। এটা এক অর্থে ভাল কারণ করের হারের ঘন ঘন পরিবর্তন ব্যবসার ক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার পথে কাঁটা হয়ে ওঠে। তবে বাজারের যা হাল তার পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য কিছুটা কর ছাড় বোধহয় দরকার ছিল।
আরও একটা অনুল্লেখ আবারও কানে বাজল। আত্মনির্ভর ভারতের উল্লেখ থাকবে এবং তাতে জোর দেওয়ার কথাও যে বাজেট প্রস্তাবে থাকবে তা সবাই আশা করেছিল। কিন্তু আরও একটা আশা ছিল যা অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে অনুচ্চারিত থেকে গেল। আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পে অনেক সংস্থাই তাদের ব্যবহারযোগ্য পণ্যের একটা বড় অংশ ছোট এবং মাঝারি সংস্থার কাছ থেকে কিনতে বাধ্য থাকেন। কিন্তু সেই পণ্যের মান যদি নিচু হয় তা হলে সেই পণ্যই আত্মনির্ভরতার স্বার্থে কেন ব্যবহার করতে হবে, সেই ব্যাখ্যা কিন্তু এই বাজেটেও মিলল না। মিলল না শিক্ষার আর স্বাস্থ্যের অধিকার সুরক্ষায় সরকারের পরিকল্পনার হদিস। অথচ এ দুইয়ের ব্যবস্থা না করতে পারলে গরিব আর বড়লোকের ক্রমবর্ধমান বিভেদকে কমানো যাবে না। অর্থমন্ত্রী সুযোগ তৈরি করতে সামাজিক পরিকাঠামোর কথা বলছেন কিন্তু সেই পরিকাঠামো ব্যবহারের দক্ষতা যদি তৈরি করতে না পারেন, তা হলে নাগরিকের অধিকার রক্ষা হবে কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু বাজেট প্রস্তাবে নেই।
চল্লিশ বছর আগে যখন প্রথম বাজেট বিশ্লেষণে সামিল হই, তখন নিয়ম ছিল বাজেটকে একটা বিশেষণে ভূষিত করা। যেমন বৃদ্ধির বাজেট ইত্যাদি। সেই অঙ্কে এই বাজেট কেমন? এক কথায়, ‘কেজো’। কারণ, সবই আছে শুধু নেই কোভিড-উত্তর দিনে খামতি পোষানোর জোরালো কোনও বার্তা।