প্রতীকী ছবি।
ঠেকে বা ঠকে কোনও ভাবেই শিখতে রাজি নই আমরা। পুজোর শুরুতেই ঠাকুর দেখার দৌড়ের ভিডিয়ো এখন ফোনে ফোনে ঘুরছে। কেউ কেউ সমীক্ষা-জ্ঞানে ঋদ্ধ হয়ে বলছেন, “দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা তো ৭০০-তেই আটকে!” কিন্তু একই সঙ্গে হাসপাতালগুলো যে ভরতে শুরু করেছে সেই খবর থেকে চোখ এড়িয়ে গিয়েছে এই মুখোশহীন আমোদ-সন্ধানী সংখ্যাতত্ত্ব ঋদ্ধদের!
একভাবে বললে, এ বারের অর্থনীতিতে নোবেল জুটেছে কাণ্ডজ্ঞানকে কার্যকারণের প্রেক্ষিতে ঝালিয়ে নেওয়ার তত্ত্বের জন্য। কিন্তু কোভিড যে ছোঁয়াচে সেই কাণ্ডজ্ঞানকে আর ঝালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আর সেই কারণেই, আমার হলে তা আমার সংস্পর্শে আসা অন্যের যে হতেই পারে, এবং তা থেকে মৃত্যুও, তা বোঝার জন্য বিরাট কোনও তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন নেই। সামাজিক স্মৃতিতেই তা জ্বলজ্বল করা উচিত। কিন্তু সামাজিক স্মৃতি দেখা যাচ্ছে বড়ই ক্ষণস্থায়ী। এর কারণ সমাজ মনস্তাত্ত্বিকরা বলবেন। আমরা ফিরি এর আর্থিক অভিঘাতে।
অর্থ মন্ত্রক মনে করছে অর্থনীতি খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। একই সঙ্গে নিফটিও ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে সেনসেক্স ৬০ হাজার স্পর্শ করার দু’সপ্তাহ বাদে। কিন্তু, পাশাপাশি, টাকার দাম আরও পড়েছে। এবং পড়েই চলেছে। ১০ বছরের সরকারি ঋণপত্রের উপর বাজারি সুদ বাড়তে শুরু করেছে।
এই সূচকগুলো বলছে, এক দিকে আশা আর অন্য দিকে সংশয় নিয়ে দোলাচলে অর্থনীতি। আশা, কারণ সরকার নানান সূচকে বাজার চাঙ্গা হওয়ার আগাম সঙ্কেত দেখছে। আশা, কারণ শেয়ার বাজার মনে করছে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তাই বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের পরে এ বার ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জেও শেয়ারের দাম চড়ছে।
সংশয়, কারণ বিশ্ববাজারে তেলের দাম আবার চড়তে শুরু করায় ডলারের চাহিদা বাড়ছে। আমেরিকার বাজারেও বিনিয়োগের উপর লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়ায়, ভারতের বাজার থেকে বিদেশি লগ্নি ঘরমুখী হওয়ায় ডলারের চাহিদা আরও বেড়েছে আর টাকার দাম পড়েছে। সংশয়, কারণ বাজার মনে করছে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়বে। আর সেই শঙ্কায় সরকারি ঋণপত্রের উপরে বাজারি সুদ চড়ছে। এই আশা ও আশঙ্কার দোলাচলের অবদান কিন্তু এই কোভিডেরই। এই আলোচনাও সেই কোভিডেরই অবদান। এটা ভুললে চলবে না।
মাথায় রাখতে হবে বাজারে চাহিদা কমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাল আসার হার যদি কমে তাতেও পণ্যের দাম বাড়তে পারে। আর উৎপাদকরা যদি মনে করেন, বাজারে চাহিদা আরও কমবে তা হলে তারাও বাজারে মাল ছাড়ার পরিমাণ কমাবেন। তার প্রভাব পড়বে মূল্য সূচকে। পণ্যের দাম বাড়বে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বার্ষিক রিপোর্টে কী বলা হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। কোভিডের কারণে গত আর্থিক বছরে জাতীয় উৎপাদন সাত শতাংশের উপর সঙ্কুচিত হয়েছিল যা ঐতিহাসিক। এবং তা হয়েছিল অতিমারির ছোবল থেকে বাঁচতে কলকারখানা বন্ধ থাকার কারণেই। কিন্তু যে পরিসংখ্যানটি সাধারণ আলোচনায় খুব একটা জায়গা পায়নি তা হল বাজারে বেসরকারি চাহিদাও সঙ্কুচিত হয়েছিল। আর তা জাতীয় উৎপাদনের অনুপাতে সঙ্কুচিত হয়েছিল ৯.৫ শতাংশ।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, বেসরকারি চাহিদায় প্রাণ না এলে অর্থনীতির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো মুশকিল। এই চাহিদা শুধু ভোগ্যপণ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে লাভ হবে না। তার পরিসর বেড়ে বিনিয়োগের চাহিদাকেও ধরতে হবে। না। এয়ার ইন্ডিয়া কেনা টাটাদের ব্যালান্স শিটে বিনিয়োগ হলেও অর্থনীতির অঙ্কে তাকে বিনিয়োগ ধরা হবে না। বিনিয়োগ ধরা হবে তাকেই যা নতুন উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করবে।
আর কোভিড নিয়ে দুশ্চিন্তার জায়গা এখানেই। স্কুল না খুললে সামাজিক সম্পদ তৈরির কাজ আরও ঘেঁটে যাবে। পুজোর পরে স্কুল কলেজ খোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অর্থনীতি বিরাট কোনও বৃদ্ধির জায়গা এখনই না পৌঁছলেও একটা ছন্দ ফিরে পেলে কর্মসংস্থানের জায়গা তৈরি হবে। তৈরি হবে পেটের সংস্থান। বিনিয়োগের চাহিদা তৈরি হবে। বাড়বে বাজারের সাধারণ চাহিদাও। কিন্তু পুজোর আনন্দ যদি হাসপাতালের আয় বাড়ায়, তাহলে কিন্তু অর্থনীতির দোলাচল বেড়ে আশার বদলে সংশয়ের পাল্লাই ভারী হবে। সঙ্কুচিত চাহিদায়, পেটের টান বাড়বে। বাজারে শঙ্কা বাড়বে উৎপাদনের বৃদ্ধি আরও ব্যাহত হবে। এ অঙ্ক আমরা বুঝতে নারাজ। রোজগার হারিয়ে কোভিডের চিকিৎসার খরচ মেটাতে পারি না পারি, পুজোয় আমাদের আত্মধ্বংসী আনন্দ চাই-ই চাই।