Budget 2021

চ্যালেঞ্জ কঠিন, কিন্তু প্রথাগত ভাবনা এড়িয়ে স্বচ্ছ, কল্যাণমুখী বাজেটের সুযোগ এটাই

দ্রুত বৃদ্ধির রাস্তায় হাঁটলেই ক্ষতি পুষিয়ে যাবে তা নয়।তবে যা হারিয়েছে তা ফিরে পাওয়ার একটা শর্ত এটা।

Advertisement

অভীক বড়ুয়া

শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২১ ২০:২৮
Share:

নির্মলা সীতারামন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

স্বাধীনতার পরে কোনও বাজেটকেই এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়নি, যা ২০২১-২২ অর্থবর্ষের বাজেটকে করতে হবে। এই বাজেটের সামনে দুটি চ্যালেঞ্জ। কোভিডের কারণে যে গাড্ডায় অর্থনীতি পড়েছে সেখান থেকে বের করে ৫ লক্ষ কোটি ডলার অর্থনীতিতে পৌঁছনোর রাস্তায় ফেরা। দুই, অর্থনীতিবিদরা যাকে ‘k’ আকৃতির বৃদ্ধি বলছেন সেই পথে হেঁটে বৃদ্ধির ফল মাত্র একটি শ্রেণির হাতে তুলে দিয়ে বাকিদের এর সুফল থেকে বঞ্চিত রাখার সম্ভাবনা এড়ানো।

Advertisement

এই দুটি লক্ষ্য কিন্তু পরস্পর বিরোধী নয়। তবে মাথায় রাখতে হবে দ্রুত বৃদ্ধির রাস্তায় হাঁটলেই যে কোভিডের কারণে ব্যক্তিগত আয়ের সূত্রে বা আয়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে যাবে তা নয়। তবে যা হারিয়েছে তা ফিরে পাওয়ার রাস্তায় ফেরার একটা শর্ত এটা। আরও একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। যদিও আমরা জিএসটি, ই-ওয়ে বিলের মতো পরিসংখ্যানের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেখছি, তবুও সরকারি তথ্যই বলছে জাতীয় উৎপাদনের সংকোচন হবে ৭.৫ শতাংশের মতো। ২০২১-এর অক্টোবর মাসের আগে (তৃতীয় ত্রৈমাসিক) কোভিডের আগের অবস্থায় আমাদের ফেরার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাই আগামী বাজেটে দুটো লক্ষ্য হওয়া উচিত। কোভিডের কারণে অর্থনীতিতে যে সংকোচন হয়েছে তা যতটা দ্রুত পারা যায় মিটিয়ে ফেলা। আর বৃদ্ধির হার যাতে দ্রুত থেকে দ্রুততর হয় সেই লক্ষ্যে কর ব্যবস্থাকে সাজানো।

বৃদ্ধির হার বাড়ানোকেই প্রাথমিক শর্ত হিসাবে দেখার কারণ তো একটাই। জাতীয় উৎপাদন না বাড়লে সবার মধ্যে তার সুফল ভাগ করার হারও তো বাড়ানো যাবে না। সরকারের কোষাগারের ক্ষমতা কিন্তু অসীম নয়। তায় রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাড়ানোরও একটা সীমা আছে। বাজার যত বাড়বে সরকারের কোষাগারেরও কর বাবদ আয় তত বাড়বে। আর অর্থনীতির রবরবা যত বাড়বে সরকারের পক্ষে বিলগ্নিকরণের রাস্তায় হেঁটে আরও বেশি টাকা বাজার থেকে তোলা সম্ভব হবে। আর সরকারের কোষাগার যত ভরবে সরকারের পক্ষেও তত আয় ও বৃদ্ধির সুফল বন্টন করে বৈষম্য কমানোর লক্ষ্যে খরচ করা সুবিধার হবে। যেমন, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য আরও সাহায্য।

Advertisement

কিন্তু এতেও সমস্যা আছে। বৃদ্ধি তো শেষে গিয়ে বাজারের চাহিদার উপর নির্ভর করে। রাজকোষ ঘাটতি বেড়ে তা হাতের বাইরে চলে গেলে বাজারের উপর ভবিষ্যতের অভিঘাত সামলানো কঠিন হয়ে যেতে পারে, তেমনই আবার সাধারণের হাতে টাকা দিয়ে বাজারে চাহিদা তৈরি করলে উৎপাদন বাড়বে আর তাতেই বৃদ্ধির রাস্তা তৈরি হবে। বর্তমান অবস্থায়, যখন অর্থনীতি সঙ্কুচিত তখন এই বাজেটের আসল চ্যালেঞ্জ রাজকোষ ঘাটতি আর বাস্তবের চাহিদার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা। রাজকোষ ঘাটতি বাড়ানোর চাপ সামলে উন্নয়নমূলক বৃদ্ধির রাস্তায় হাঁটতে হবেই।
অন্য দেশগুলি যখন অতিমারির শুরুতেই রাজকোষের উপর রাশ আলগা করেছিল, ভারত কিন্তু তখনও প্রথাগত রাস্তায় হেঁটে রাজকোষ সামলেছে। রাজকোষ থেকে ত্রাণের পরিমাণ ছিল জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ২.৩ শতাংশ। এখন যখন অর্থনীতি ঘুরছে তখন কিন্তু সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কী ভাবে দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়িয়ে বৃদ্ধির হারকে বাড়ানো যেতে পারে। তা করতে কিন্তু রাজকোষের রাশ আরও আল্গা করতে হতে পারে।

চ্যালেঞ্জ যে শুধু কর ব্যবস্থা আর খরচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা নয়। স্কুল দীর্ঘ কাল ধরে বন্ধ। ছাত্ররা প্রায় দু’বছর বা তারও বেশি ক্লাসে বসে প্রত্যক্ষ শিক্ষার সুযোগ হারাতে চলেছে। ডিজিটাল ক্লাস যে প্রত্যক্ষ ক্লাসরুম শিক্ষার পরিপূরক হতে পারেনি তা মোটামুটি সবাই মেনে নিয়েছেন। শিক্ষার এই খামতি কিন্তু পূরণ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকেই মনে করছেন যে এর প্রভাব এখনই বোঝা না গেলেও, আগামীতে যখন এই সব ছাত্রছাত্রীরা কাজের বাজারে আসবে তখন বোঝা যাবে আমরা কী হারিয়েছি। কোভিডের এই সময় অর্থনীতির উপর মানবসম্পদের কী ক্ষতি করেছে। বাজেট মূলত কর প্রস্তাব। তার মধ্যে সব কিছুর সমাধান খোঁজা যায় না। এটা মেনে নিয়েও এই কর প্রস্তাবের মধ্যেই কিন্তু এই সমস্যা মোকাবিলার রাস্তার হদিশ থাকা উচিত। এই সমস্যা মেটাতে শিক্ষা পরিকাঠামো খাতে কী ভাবে খরচ বরাদ্দ হবে সেটাই হবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অন্যতম দিশা, যেমন আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের সন্তানেরা কী ভাবে ইন্টানেটের সুযোগ পাবে, বা ট্যাবলেট ব্যবহার করতে পারবে তার দিশা।

আসা যাক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়। অতিমারি কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সুবিধা ও অসুবিধা দুই-ই সামনে তুলে ধরেছে। এত দিনের ধারণাও ভেঙে দিয়েছে। আমরা ভাবতাম আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বোধহয় খুবই দুর্বল। কিন্তু আমাদের টিকা পরিষেবা যে ভাবে এত দ্রুত কোভিড ভ্যাকসিনকে মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারছে, তা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বেশ নড়বড়ে। আমাদের যদি কোভিড অতিমারির মতো আরও কোনও অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়, তার সঙ্গে যুঝতে এখনই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খামতি বোজানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাই ব্যয় বরাদ্দের প্রথাগত চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কৌশল তৈরি করতে হবে বৈকি।

লোকে বলে সব বিপদই নতুন সুযোগ তৈরি করে। কোভিড থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার কিন্তু নাগরিকের প্রতি আরও সংবেদনশীল, কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। তবে তা করতে হলে কোষাগারকে শক্তিশালী হতে হবে। নাগরিক অভিমুখী শাসন শুধু উচ্চারণে থাকলেই হবে না। এই বাজেটকে যদি সত্যিই পরিবর্তনের বাজেট হতে হয়, তা হলে কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার কী করতে চায়, তার নীতি কী, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ভাবে নিজের চিন্তাকে তুলে ধরতে হবে। জানাতে হবে ঠিক কী ভাবে বিলগ্নিকরণের রাস্তায় এই প্রশাসন হাঁটতে চাইছে। জানাতে হবে ঠিক কী ভাবে রফতানি এবং আমদানির বদলে দেশে উৎপাদনের কৌশল নিয়ে ভাবছে। জানাতে হবে কী ভাবেই বা পঙ্গু পরিকাঠামোকে চাঙ্গা করতে চায় সরকার ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement