দেবলীনা দত্ত।
ইদানীং শুনছি, আমি নাকি খুব কথা বলছি। আর এই কথা বলতে বলতেই আমি নাকি একদিন ভোটের টিকিট পেয়ে যাব। আনন্দবাজার ডিজিটালের এই লেখায় বলে রাখি, আমি কোনও দিনই ভোটে দাঁড়াব না। সকলের শুভেচ্ছা এবং আশীর্বাদে একজন অভিনেতা হিসেবে মানুষ আমার কথা এমনিই শোনে। এক বছর আগেই আমার স্বামী তথাগত আর আমাকে দলে নিতে উঠেপড়ে লেগেছিল বিজেপি। বলেছিল, ‘‘আপনারা কুকুরদের দেখেন। আমরা গরুদের দেখি। দু’পক্ষ একসঙ্গে কাজ করা যাবে।’’ আমরা যাইনি। কুকুরদের সেবা করার জন্য আমাদের বিজেপি-কে প্রয়োজন হয়নি। এখনও নেই। অতএব ভোটের টিকিট পাব বলে আমি এই লড়াই করছি না।
সম্প্রতি আমার একদা বন্ধু অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ আমায় ধর্ষণের হুমকি দেওয়াকে ‘নিন্দনীয়’ বলেছে। তবে আবার পাশাপাশি প্রশ্নও তুলেছে, ‘‘আমার মা আমাকে অষ্টমীর দিন গরুর মাংস রেঁধে দেবেন কি না।’’ এটা তো শুধু শিরোনাম। আনন্দবাজার ডিজিটালে দেখলাম, ও আমাকে বন্ধু হিসেবে ভুল শুধরে নেওয়ার উপদেশও দিয়েছে। লিখেছে, ‘‘অষ্টমীর দিন বাড়িতে মাছ পর্যন্ত না-ছোঁয়া বাঙালিকে গরুর মাংস রান্নার কথা বলে আমি নাকি তাঁদের ভাবাবেগে চরম আঘাত দিয়ে ফেলেছি!’’ রুদ্রনীল আমাকে বন্ধু হিসেবে উপদেশ দিলেও আমি কিন্তু উত্তরগুলো ওর বন্ধু হয়ে দিচ্ছি না। ওকে আমি আর আমার বন্ধু বলে মনে করি না। আমার কাছে রুদ্রনীলের এই ‘হিন্দুত্ববোধ’-এ আঘাত লাগাটা আসলে খুব হাস্যকর বলে মনে হচ্ছে।
আমি যখন পুজোর সময় গরুর মাংস রান্নার কথা বলেছিলাম, তখন রুদ্রনীলও সেখানে ছিল। ওর সামনে মঞ্চ। হাতে মাইক্রোফোন। সত্যিই ওর হিন্দুত্ববোধে আঘাত লেগে থাকলে তখনই কেন প্রতিবাদ করল না? উল্টে মঞ্চ থেকে নেমে এসে বত্রিশ পাটি বার করে আমার হাত চেপে ধরে শুভেচ্ছা জানাল। আমার কথাগুলো যে ওকে এত আঘাত করেছে, তখন সে কথা ও বন্ধুত্বের সুরেই আমায় জানাতে পারত। তখন কোথায় ছিল ওর প্রতিবাদ? এখন দল বদলাচ্ছে বলে কি ওদের (বিজেপি) সুরে সুর মেলাচ্ছে? সেই সময় ওর হাসিমুখ এবং শুভেচ্ছা বিনিময়ের নম্রতা দেখে মনেই হয়নি, কোথাও কোনও খারাপ-লাগা ওর মনে দাগ কেটেছে। আমি যদি বিজেপি করতাম এবং আমার হিন্দুত্ববোধে আঘাত লাগত, তা হলে অতি অবশ্যই মামলা করতাম। যিনি কথাগুলি বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে নয়, আমার দলের যে ব্যক্তি সামনে মাইক্রোফোন থাকা সত্ত্বেও ‘আপত্তিজনক’ কথাগুলি শুনে চুপ করে থেকেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে। আমার মনে হয়, কথাগুলো বলার জন্য যদি আমি অপরাধী হই, তা হলে চুপ করে থাকার জন্য রুদ্রনীলও ততটাই অপরাধী। রুদ্রনীল বলেছে, আমার ভুল সংশোধন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে বলি, আমি খুব প্রবল চিত্তের মানুষ। তাই বুঝেশুনে, ভেবেচিন্তে কথা বলি এবং তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠলেও অনড় থাকি। রুদ্রনীলের মতো বারবার দল বদল করে নিজেকে সংশোধন করতে হয় না। ও দুর্বলচিত্তের বলেই বারবার এ রকম করে।
রুদ্রনীল ঘোষ এবং রুপাঞ্জনা মিত্র।
এ বার উত্তরের পরিবর্তে একটা প্রশ্ন করি?
রুদ্রনীল কোন যুক্তিতে এই গোটা বিষয়টার মধ্যে আমার মা’কে টেনে আনল? আমি কিছুতেই সেটা বুঝে উঠতে পারছি না! ও আমার মা’কে ব্যক্তিগত ভাবে চেনে। দেখা হলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করে। ওর সঙ্গে তো আর আজকের আলাপ নয়। রুদ্রনীল আমার বহু পুরনো সহকর্মী। ‘এক নম্বর মেস বাড়ি’-তে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। প্রথমবার ওর ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর সাক্ষী আমি। এই বিতণ্ডায় কোনও কারণ ছাড়া আমার মা’কে টেনে এনে রুদ্র নারীদেরই অসম্মান করল। ওর বিরুদ্ধে যখন ৪৯৮এ ধারায় মামলা হয়েছিল, ওকে জেল খাটতে হয়েছিল, তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। ওর প্রত্যেকটা কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছিলাম। ভেবেছিলাম ও নির্দোষ। ওকে ফাঁসানো হচ্ছে। এখন প্রতি মুহূর্তে ওর দল বদলে ফেলা এবং নারীদের প্রতি অসম্মানের প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, ওর বোধহয় ওটা পাওনা ছিল। যে মানুষ কারও মা’কে টেনে কথা বলতে পারে, সে কোনও মহিলার সঙ্গেও অসভ্যতা করতে পারে। সম্প্রতি একটা অডিয়ো ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। সেখানে ঐন্দ্রিলা নামে একটি মেয়ে বলেছে, সে যখন রুদ্রনীলের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল, তখন নিস্তার পাওয়ার জন্য রুদ্রনীল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পায়ে পড়েছিল। দিদিই তখন ওকে বিশ্বাস করে বাঁচিয়েছিলেন। এখন রুদ্র সেই দিদির বিরুদ্ধেই চলে গেল! আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই রুদ্রনীল বিজেপি-তে যাচ্ছে। সহকর্মীদের মুখ বদলে যাচ্ছে।
দেখলাম শুক্রবার আনন্দবাজার ডিজিটালে রূপাঞ্জনা লিখেছে, আমি আর সায়নী ঠিকই বলেছি। ডাকলে নাকি ধর্মতলার প্রতিবাদে ও-ও যেত। কিন্তু আনন্দবাজার ডিজিটালের পাঠকরা কি জানেন, আমার ওই ঘটনার পর রূপাঞ্জনা লিখেছিল ‘এই সব সেক্যুলারদের আমি মানুষের পর্যায়ে ফেলি না। #চাইল্ডসপ্লে’। মজার বিষয়, আমাকে এবং তথাগতকে ‘হাইড’ করে রুপাঞ্জনা ফেসবুকে ওই পোস্টটা দিয়েছিল। অন্য একজন আমাকে পোস্টটা দেখায়। আমার কাছে সেই ‘স্ক্রিনশটও’ রয়েছে।
‘সহকর্মীদের মুখ বদলে যাচ্ছে।’
ব্যক্তিগত ভাবে রূপাঞ্জনাকে খুব পছন্দ করতাম। কারণ, ও আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ধর্মনিরপেক্ষতার একটা বড় উদাহরণ। কিন্তু নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে একজন মুসলিম পুরুষকে বিয়ে করে নাম পরিবর্তন করা রূপাঞ্জনাও নাকি বলছে, ও ‘সেক্যুলারদের’ মানুষ বলে ভাবে না! রূপাঞ্জনা আরও একটা পোস্ট করেছিল। সোশ্যাল মিডিয়ার হুমকিকে ভয় না পাওয়ার উপদেশ দিয়েছিল সেখানে। যদি ওকে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় ধর্ষণের হুমকি দেয়, ওর মা’কে টেনে কথা বলে, তখন কি ও ভয় পাবে না? আমি জানতে চাই। যদি ও এ ধরনের হুমকি পেয়ে থেকেও চুপ করে থাকে, তা হলে ওকে ‘ভীতু’ তকমা দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না আমার। কিন্তু ও প্রতিবাদ করবে না বলে বাকি সকলেই চুপ করে থাকবে, এটা ভাবাও তো ভুল!