নয়ানাভিরাম রাস্তা। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। শীতে বরফে ঢাকা গ্রাম। পাণ্ডবদের স্বর্গযাত্রার আগে শেষ রান্নার উনুন— সব তো পাবেনই, সঙ্গে হাত বাড়ালেই হিমালয়ের আরেক অপরূপ দর্শনের মহা সুযোগ! হোক না, এ বছরের পুজো ট্যুরে উত্তরাখণ্ডের এই অত্যাশ্চর্য গ্রামই আপনার গন্তব্যস্থল!
নাম তার মুন্সিয়ারি। গঞ্জ মানে গ্রাম। এটাও গ্রাম। তবে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ নয়। আমাদের দেশের কুমায়ুন অঞ্চলের মুন্সিয়ারি গ্রাম। পিথোরাগড় জেলার অন্তর্গত এক অত্যাশ্চর্য গ্রাম!
রোমহর্ষক রাস্তা, পৌরাণিক কাহিনির স্থান, ট্রেকিংয়ের মজা, বেশি শীতে বরফের সাদা চাদরে ঢাকা চারপাশ, প্রকৃতির হাত উপুড় করে ঢেলে দেওয়া অফুরন্ত সৌন্দর্য এবং অতি অবশ্যই একেবারে যেন গায়ের কাছেই হিমালয়ের অন্য এক রূপ অপেক্ষমান পর্যটকদের জন্য! উত্তরাখণ্ডের সত্যি সত্যিই এ এক অতুলনীয় গ্রাম— মুন্সিয়ারি।
উত্তরাখণ্ডকে বলা হয় দেবভূমি। পুরাণে পাওয়া যায়, দেবতাদের বসবাসের জায়গা ছিল উত্তরাখন্ড। মুন্সিয়ারিও সেই পবিত্র দেবভূমির এক অংশ। স্বয়ং মহাকাব্য মহাভারতের যোগ রয়েছে মুন্সিয়ারির সঙ্গে। কথিত আছে, কুরুক্ষেত্র জয়ের পর শেষমেশ তাঁদের বংশধরদের হাতে রাজত্বের দায়িত্বভার তুলে দিয়ে পাণ্ডবেরা স্বর্গযাত্রার পথে রওনা হয়েছিলেন মুন্সিয়ারি থেকেই। তার আগে মর্ত্যে তাঁদের শেষ রান্না পান্ডবেরা করেছিলেন এখানকার পঞ্চচুল্লিতে। পাঁচ শৃঙ্গের জন্য এই হিমালয়ান রেঞ্জের নাম পঞ্চচুল্লি। খেয়াল করুন, চুল্লি-র অর্থ কিন্তু উনুন!
মুন্সিয়ারি এমন এক আশ্চর্য জায়গা যে, এই একটা গ্রাম থেকেই দেখা যায় পঞ্চচুল্লি ছাড়াও নন্দাদেবী, নন্দাকোট, রাজারম্ভার শৃঙ্গ। আরও তাৎপর্যপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থান মুন্সিয়ারির। তিব্বতের প্রাচীন ‘সল্ট রুট’ গিয়েছে এই গ্রামকে ছুঁয়ে। আবার এখানে পৌঁছতে কালামুনি পাস পেরোতে হয়। যার উচ্চতা ৯০০০ মিটারেরও বেশি হওয়ায় দেবভূমি উত্তরাখন্ডের আরেক অসাধারণ রূপের দৃশ্যসুখ চেটেপুটে উপভোগ করা যায়। এর মাত্র ৩৫ কিলোমিটার আগে আছে বিরথি জলপ্রপাত। ১২০ মিটার উচ্চতা থেকে আছড়ে পড়া এই জলপ্রপাতের ভয়াল অথচ রোম্যান্টিক রূপ পর্যটকদের কাছে অতিপ্রিয়।
মুন্সিয়ারি শান্ত গ্রাম। অথচ এখানে প্রচুর মানুষের বসবাস। এ ছাড়াও ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে জনপ্রিয়তার জন্য প্রায় সারা বছর মুন্সিয়ারিতে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। ভ্রমণপিয়াসী বাঙালি বহু যান মুন্সিয়ারি-পঞ্চকুল্লা বেড়াতে।
এই গ্রামেই নন্দাদেবীর মন্দির। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অসামান্য সমাহার। মন্দিরের পাশে সবুজে সবুজ এক বিরাট মাঠের নিস্তব্ধতার রূপ এমনই সুন্দর যে, প্রচুর লোকজন সেখানে কেবল ঘন্টার পর ঘন্টা বিশ্রাম নিতেই বসে থাকেন, তাই নয়, এর অপরূপ আবহে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন যেন!
যাঁরা তুষারবৃত্ত পর্বতশৃঙ্গ দেখতে ভীষণ ভালবাসেন, ট্রেকিংয়ে ইচ্ছুক, তেমন পর্যটকদেরও নিরুৎসাহিত করে না মুন্সিয়ারি। অত্যাশ্চর্য এই গ্রাম থেকে মনে হবে যেন হাত বাড়ালেই বরফে ঢাকা নন্দাদেবী শৃঙ্গ।
এমনকী ভাগ্যে থাকলে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে মুন্সিয়ারি গ্রামে তুষারপাতের সাক্ষীও থাকতে পারেন আপনি। নিরাশ হবেন না ট্রেকিং প্রিয় পর্যটকেরাও। কারণ, মুন্সিয়ারি থেকেই এ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খালিয়া টপ ট্রেকিং শুরু হয়।
এমনকী ট্রেকের যাবতীয় সরঞ্জাম কিনতেও পেয়ে যাবেন মুন্সিয়ারি বাজারে। মায়, ট্রেকিংয়ের পোর্টার অর্থাৎ কুলি পর্যন্ত পেয়ে যাবেন সেখানে। তাহলে? হোক না, এবারের পুজো ভ্রমণে উত্তরাখন্ডের অত্যাশ্চর্য গ্রাম মুন্সিয়ারি আপনার গন্তব্যস্থল?
কীভাবে যাবেন: মুন্সিয়ারি পৌঁছনো একটু কঠিন। কারণ, দেশের কোনও বড় শহরের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত নয় এই পর্যটন কেন্দ্র। আবার মুন্সিয়ারির নিকটতম রেল স্টেশন এবং বিমানবন্দরের দূরত্ব ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি। এ সবের জন্য যাত্রাপথে এক-আধ দিন অন্যত্র থাকতে হয়। বিমানবন্দরের ভেতর মুন্সিয়ারির নিকটতম হল দেরাদুন বিমানবন্দর (২১৪ কিমি) এবং পন্তনগর বিমানবন্দর (২৪৯ কিমি)।
সবচেয়ে কাছাকাছি রেল স্টেশন দেরাদুন (২১৪ কিমি), কাঠগোদাম (২৭৫ কিমি) এবং টনাকপুর (২৮৬ কিমি)। সড়কপথে প্রধানত দিল্লি থেকে রাষ্ট্রীয় পরিবহনের বাস এবং প্রাইভেট বাস ছাড়ে। এছাড়া, অনেক ট্যাক্সি এবং জিপ ভাড়া পাওয়া যায়। সবের ভাড়া ঋতু, বৃষ্টি, ধস, তুষারপাতের উপর কম-বেশি নির্ভর করে। তবে অত চাপ নেই। এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।