পুজোর বয়স ৫০০ পেরিয়েছে। আগে পুজো হত ত্রিপল খাটিয়ে। এখন হয় সিমেন্টের দালানওয়ালা মন্দিরে। পুজোর আচারে এখানে অনেক রকম বৈশিষ্ট্য।
গ্রামের ঢালাই রাস্তা। চারপাশে গাছের সারি। শরতের হাওয়ায় দুলছে। রাস্তার ধারে মন্দির পাঁচিল ঘেরা। ভিতরে ঢুকতেই দু’টো ঘর। কিছুটা এগোলে সদর দালান। মাঝে বলির স্থান। সদর দালানের পিছনে মূল মন্দির। মন্দির লাগোয়া ঘাট বাঁধানো পুকুর। টলমল করছে জল। পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, নীল আকাশ, তাল, নারকেল গাছের ছায়া পড়েছে। হুগলির দশঘড়া ‘চোদ্দ ঘর’ বসু বাড়ির দুর্গা দালান।
ধনিয়াখালি হল্ট স্টেশন থেকে গ্রামের আঁকা বাঁকা পথ পেরিয়ে গাড়ি করে মিনিট ১০-১৫ গেলেই ৫১৬ বছরের পুরনো ‘চোদ্দ ঘর’ বসু বাড়ির দুর্গাপুজো।
১৬০৫ সালে কর্তা রঘুনাথ বসু এই পুজো শুরু করেন। তবে জানা যায়, ১৫০৭ সালে ঘট পুজোর মাধ্যমে এই পুজো শুরু হয়। কিছু বছর পরে তিনি চাকরি সূত্রে ভদ্রকালীতে চলে যান। তখন পুজো হত, কিন্তু আড়ম্বর কমে যায়।
১৭৪৫ সালে শ্রীযুক্ত রামনারায়ণ বসু এই পুজো আবার মহা সমারোহে শুরু করেন। স্থায়ী ভাবে দশঘড়ায় চোদ্দো ঘর বসু বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। একদম প্রথম দিকে ত্রিপল খাটিয়ে ছাউনি করে পুজো করা হত। পরে মাটির মন্দির। তার পর হয় কাঠের মন্দির। তিন-চার পুরুষ আগে সিমেন্টের দালান তৈরি হয়েছে। এখন সেখানেই পুজো হয়। উল্টো রথের দিন প্রতিমার কাঠামোতে মাটি দিয়ে পুজোর প্রস্তুতি আরম্ভ হয়। এই বাড়ির পটুয়ারা বংশ-পরম্পরায় ঠাকুর তৈরি করে আসছেন।
এর পর মহালয়ার দিন ডাকের সাজে প্রতিমাকে সম্পূর্ণ ভাবে তৈরি করা হয়। এক চালার প্রতিমায় চালচিত্রে আঁকা থাকে ১০ মহাবিদ্যার ছবি। পিতৃপক্ষের অবসানের দিনেই মাকে সাজিয়ে তোলার পিছনে কারণ রয়েছে। কারণটা হল, পর দিন অর্থাৎ প্রথমা বা প্রতিপদের দিন থেকেই এখানে পুজো শুরু হয়। এ দিনই ঘট স্থাপনের মাধ্যমে চণ্ডীপাঠ শুরু করা হয়।
বসু বাড়ির পুজোতে ষোড়শোপচারে দেবীর আরাধনা করা হয়। কী এই ষোড়শোপচার? কৈলাস থেকে সুদীর্ঘ পদ অতিক্রম করে মা আসেন বলে বিশ্বাস করা হয়। সে ক্ষেত্রে তাঁর পথের ক্লান্তি কাটাতে পুজোয় বিভিন্ন রীতি মানা হয়। যেমন, মায়ের বসার জন্য আসন রাখা, পা ধুইয়ে দেওয়া, বস্ত্র, অলংকার, ধুনো দেওয়া, মায়ের ক্লান্তি দূর করানোর চেষ্টা ইত্যাদি ইত্যাদি। ষষ্ঠীর দিনও একই পদ্ধতিতে চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে মায়ের বোধন সম্পূর্ণ হয় এখানে।
ষষ্ঠীর রাতের বেলায় সপ্তমীর জন্য কলাবউ বা নবপত্রিকার স্নানের প্রস্তুতি সাড়া হয়। মন্দির লাগোয়া পুকুরে, সপ্তমীর দিন নব পত্রিকার স্নানের পর্বটি সম্পূর্ণ হয়।এখানেই রয়েছে চমক। নবপত্রিকার স্নানের সঙ্গে সঙ্গে গায়ে হলুদের বিষয় এখানে রয়েছে। রাতে মা ষষ্ঠীর পুজোর শেষে মা দুর্গাকে তিনটি উপকরণের সাহায্যে আহ্বান করা হয়। সেক্ষেত্রে পঞ্চপ্রদীপ, বরণ ডালা এবং চামর দিয়ে বাতাস করে দেবীকে বরণ করা হয়।
এর পরে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমীর পুজো পারিবারিক নিয়ম মেনে সম্পন্ন করা হয়। আগে এখানে মহিষ বলি দেওয়া হত। এখন হয় না। কিন্তু বলির সেই খর্গ এখনও অক্ষত রেখেছেন তাঁরা। এখন অবশ্য পাঁঠা বলি দেওয়ার রীতি আছে।
দশমীর দিন নীলকন্ঠ পাখি দেখার লক্ষ্যে পরিবারের সকলে হাঁটা শুরু করেন। কিন্তু এখন সেই পাখি প্রায় বিলুপ্ত। তাই বিকল্প পথ বেছে নিয়েছে তাঁরা। দূরে অন্য একটি গ্রামের মন্দিরে বানানো হয়েছে, নীলকণ্ঠ ও শঙ্খচূড়ের মূর্তি। পরিবারের লোকজন ওই বানানো পাখি দু’টি দেখেই বাড়িতে ফিরে আসেন।
সারা বছর পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় কাজের সূত্রে থাকেন। তবে পুজোর এই ক’টা দিন বাড়ির প্রত্যেক সদস্য এক জায়গায় এসে উৎসবে মেতে উঠেন। এ তো গেল পুজোর বিভিন্ন রীতি। এর বাইরে কিছু অনুষ্ঠান হয়, পুজোর ক’টা দিন। বাড়ির মহিলারা বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেখানে তাঁরা অংশগ্রহণও করেন। সিঁদুর খেলার প্রথাটি এখানে একটু হলেও আলাদা। অন্যান্য জায়গায় দশমীর দিন সিঁদুর খেলা হয়। এ বাড়িতে সেখানে নবমী এবং দশমী দুই দিন সিঁদুর খেলা হয়ে থাকে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।