সময়টা ১৭০০ থেকে ১৮০০ সালের মাঝামাঝি। তখন বেশ কয়েক দশক কলকাতার দুর্গাপুজো হয়ে গিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্গোৎসব। ১৮৪০ সালে কোম্পানির ‘দশ নম্বরি আইন’ পাস না হওয়া পর্যন্ত কলকাতার দুর্গোৎসব এমনটাই ছিল। এ উৎসব ঘিরে এদেশের মানুষজনদের যত না আনন্দ-আহ্লাদ থাকত, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি আমোদ ছিল কোম্পানির লোকেদের।
কোম্পানির দুর্গোৎসব ঘিরে ছিল বিভিন্ন প্রতিযোগিতা। যেমন, কার বাড়ির দুর্গাকে বেশি গয়না পরানো হয়েছে, কার বাড়িতে বাইরের প্রদেশের সুন্দরী বাইজি নাচবে, কার পুজোয় ইংরেজ রাজ-কর্মচারী হাজির থাকবেন, কিম্বা কার বাড়ির পুজোয় অঢেল খানাপিনার আয়োজন করা হয়েছে, এমন হাজারটা বিষয়। এই বিষয়গুলি নিয়ে তখন সংবাদপত্রগুলিতে নিয়মিত খবর প্রকাশিত হত। আর সাধারণ মানুষ মুখিয়ে থাকত এই প্রতিযোগিতার খবর পড়তে।
১৮২৯ সালে ‘সমাচার দর্পণ’ লিখছে, ‘প্রাক-কোম্পানি যুগের পুজো ছিল সর্বত্র প্রতিমা না হউক ঘটপটাদি এবং শ্রীশ্রীশালগ্রাম শিলাদির পুজো। আর সেসময়ের আদর্শ মহারাজা হলেন কৃষ্ণচন্দ্র। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রথমত এই উৎসবে বড় জাঁকজমক করেন।’
হিন্দুদের দুর্গাপুজো রাতারাতি কীভাবে কোম্পানির পুজোয় পরিবর্তিত হয়ে যায়, তার কারণটি বেশ স্পষ্ট। গবেষকদের মতে, ইংরেজদের ‘তুষ্টিকরণ নীতি’-ই ছিল এর নেপথ্যের কারণ। ইংরেজরা তখনও এদেশে জাঁকিয়ে বসেনি, তারা তখন অনকাংশেই ব্যবসায়ী এবং এদেশের আধা-শাসক। যার ফলে তারা চাইছিল, এদেশের মানুষদের খুশি করতে। যে কারণে এদেশের যাবতীয় ধর্মাচারের পুরো-পৃষ্ঠপোষকতা করতে নিজেরাই এগিয়ে আসে তারা। তখনই দুর্গাপুজোগুলিতে পৃষ্ঠপোষকতা শুরু হয় তাদের তরফে।
১৮১৯ সালে ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ লিখছে, ‘এই প্রেসিডেন্সিতে ইতিপূর্বে এ ধরনের পুজো কেউ কখনও দেখেনি। সুগায়িকাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিপুল অর্থব্যয়ে আনা হচ্ছে।’ কলকাতার এই পুজোগুলিতে বাইজি নাচ ছিল মুখ্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এ ব্যাপারে ১৮২৬ সালের গভর্নমেন্ট গেজেট লিখছে, ‘গোপীমোহন দেবের বাড়িতে নাচবার জন্যে সুদূর ব্রহ্মদেশ থেকে একদল সুন্দরী এবং সুগায়িকা নর্তকী আনা হয়েছে।’ দুর্গাপুজোর বাইজি নাচ ঘিরে ছিল এক বিরাট প্রতিযোগিতার আসর।
পুজোর পরেই আবার প্রতিবেদন বেরত কাগজে। বড় বড় বাড়ির গৃহকর্তারা অধীর আগ্রহে বসে থাকতেন, ছাপার হরফে ইংরেজি কাগজে কবে তাঁদের নাম বেরবে তার জন্য। ক্যালকাটা গেজেট এক খবরে লিখছে, ‘প্রাচ্যের জাঁকজমকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপিয়ান রুচি’ ইত্যাদি। তার সঙ্গে নাচ! রামচন্দরের বাড়িতে যেমন নিকি নেচেছে, তেমন রূপচাঁদ রায়ের বাড়িতে নেচেছে বুনু। জনৈকা কাশ্মীরি সুন্দরী।’
ধীরে ধীরে দিন বদলে গেল। ১৮২৯ সালে সংবাদপত্রে এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হল, ‘পূর্বে এই দুর্গোৎসবে যেরূপ সমারোহ নৃত্যগীতাদি এক্ষণে বৎসর ২ ক্রমে ঐ সমারোহ ইত্যাদির হ্রাস হইয়া আসিতেছে।’
সেসময়ের জনপ্রিয় কাগজ ‘জন বুল’ দুর্গোৎসবের ভাটা পড়ার বেশ কয়েকটি কারণকে, বলতে গেলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। যার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ব্রিটিশ শাসকদের বোধোদয়’ তথা ‘জ্ঞানবৃদ্ধি’।
এই বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে যায় ১৮৩৩ সালের একটি ঘটনায়। যখন ডিরোজিওর 'ইয়ং বেঙ্গল’ জোরদার আওয়াজ তুলল কোম্পানির সহায়তায় বাবুদের দুর্গোৎসবের বেহিসেবি খরচপত্তর নিয়ে। তারা বলল, দুর্গাপুজোয় বাইজি নাচিয়ে আর খানাপিনা করে কোম্পানি সরকার এবং বাবুরা সাধারণ মানুষের কী এমন হিত সাধন করছে?
শুধু তাই নয়। কলকাতার বড়মানুষদের কী কী বিষয়ে খরচ করা উচিত সে বিষয়ে তারা একটি ফর্দ অবধি পেশ করল। যার মধ্যে ছিল ‘বিলাতে গমনোপযুক্ত জাহাজ নির্মাণ’, ‘নানাবিধ শিল্প যন্ত্র স্থাপন’’ থেকে ‘চাষ বৃদ্ধি’র দিকে নজর দেওয়ার মতো যুগান্তকারী দাবি।
এবার কোম্পানির টনক নড়ল। আর সে বছরই বের হল কোম্পানির বিখ্যাত ঘোষণা, হিন্দুদের মন্দিরাদি থেকে সরকারিভাবে হাত উঠিয়ে নিচ্ছেন তারা। এর ক’বছরের মধ্যেই ১৮৩৭ সালে বন্ধ হয়ে গেল হিন্দুর উৎসবে তোপ দাগানো আর দুর্গাপুজোর ধুমধাম। অবশেষে ১৮৪০ সালে এল বিখ্যাত ‘দশ নম্বরি আইন’। যে আইনের সহজ মর্ম ছিল, ‘নেটিভরা প্রজা, আমরা রাজা। তাদের ধর্ম তাদের, আমাদের ধর্ম আমাদের।’
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।