মগ্ন: থিম ফুটিয়ে তোলার কাজে ব্যস্ত গৌরী বেড়িয়া সর্বজনীনের শিল্পী সৌরভ নাগ।—নিজস্বচিত্র।
সামনে প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে দুর্গা মূর্তি।পিছনে বিশাল মহাকাল— অর্থাৎ, নটরাজের কাঠামো। সেখানেই চেতলা অগ্রণীর থিম-শিল্পী অনির্বাণ দাস বললেন, “একটা সুন্দর পাত্রে অনেক গুলো হিরের টুকরো রাখলে দেখতে যে দারুণ লাগবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।কিন্তু হিরের টুকরোর অনেক দাম।ওই জায়গায় ওই সুন্দর পাত্রেই কিছুটা জল দিয়ে তার মধ্যে কয়েকটা শিউলি, বেল বা পুরনো বকুল ফুল রেখে দিলে যে স্বর্গীয় সৌরভ ছড়াবে, তারও কি তুলনা হয়? এজন্যই শিউলিকে পারিজাত বলা হয়। এবারের পুজোয় ওই পারিজাত খুঁজে বার করাই শিল্পীর কাজ।”
করোনার পরিবেশে পুজোর খরচ তুলতে নাজেহাল পুজো উদ্যোক্তারা।তাই অনেকেই সাবেক পুজোয় ফিরে গিয়েছেন।যাঁরা থিমের পুজো করছেন, তাঁরা শিল্পী দের বলে দিয়েছেন, খুব কম বাজেটে কিছু করতে।কম বাজেটের থিম করতে গিয়ে শিল্পের মানের সঙ্গে কোথাও আপস করতে হচ্ছে? প্রশ্ন উঠছে, বাজেট কম হলে শিল্পীও কি কাজের মান নামিয়ে দিতে পারবেন?
আরও পড়ুন: নেই-রাজ্যের পুজোয় রং, মাটি, অসুর, অস্ত্র ছাড়াই চমক প্রতিমায়
শিল্পীরা অবশ্য জানাচ্ছেন, বাজেট কমলেও শিল্পের সঙ্গে কোনও আপস নয়। বরং সবটাই হচ্ছে, কলকাতার পুজোর মান বজায় রেখেই।শিল্পী ভবতোষ সুতার যে মন বললেন, “নাকতলা উদয়ন এবং সুরুচি সঙ্ঘের পুজোর কাজ করছি এবার।নাকতলায় আবহ সঙ্গীতে শঙ্খ ধ্বনি, কবীর সুমনের সৃষ্টির সঙ্গে সম্পূর্ণ সাদা রঙের মণ্ডপ একটা অদ্ভুত তরঙ্গের জন্ম দেবে।আর সুরু চিতে হচ্ছে মানুষের পুজো।আট মাসের কাজ একমাসে করা হয়েছে।কিন্তু দেখে বোঝা যাবেনা।” তাঁর দাবি, “দিনে দিনে বাজেট বেড়ে মোটা টাকার থিম হলেও শিল্পের উত্তরণ কতটা হয়েছে জানিনা।তবে ইন্ডাস্ট্রি বেড়েছে।প্রচুর লোকের কর্ম সংস্থান হয়েছে।সেটা বড় ব্যাপার।কিন্তু শিল্পের দিক থেকে এবারই সেরা সময়।প্রতিকূল তার মধ্যেই তো শিল্পের ব্যাপ্তি ভাল হয়।”
হাতিবাগান সর্বজনীনের শিল্পী সঞ্জীব সাহার কথায়, “যে জিনিস মানুষ ফেলে দেয়, বাজারে যার মূল্য খুব কম, তেমন জিনিস নিয়েই এবার কাজ করছি।আর শিল্প কাজ করতে করতে তৈরি হয়।”
একই কথা শোনালেন লেক ভিউ রোডের সমাজ সেবী পুজো কমিটির শিল্পী প্রদীপ দাস।তিনি বললেন, “বাজেট কম যে হবে, সেতো মার্চ থেকেই বোঝা গিয়েছিল।সমাজ সেবী পুজো কমিটি ৭৫ তম বছরে এবার সুন্দরবনের ৭৫ টি পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে।হিঙ্গলগঞ্জ থেকে বালিগঞ্জের এই সেতু বন্ধনই থিমের মাধ্যমে দেখাচ্ছি।খরচটা ব্যাপার নয়, এখন খুব কম টাকায় মান ধরে রাখাই আসল।”
কাশী বোস লেন এবং দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘের থিম শিল্পী পরিমল পাল জানালেন, কাশী বোস লেনে বিশাল ঘটের আদলে মণ্ডপ তৈরি কর ছেন।ভিতরে এক চালার সাবেক প্রতিমা।দমদম পার্কে তুলে ধরছেন, একটি খাঁচা বন্দি শহরের দৃশ্য।যেখানে সময় থমকে যাওয়া দেখানো হবে একটি তালার মধ্যে।শিল্পী বললেন, “মাস তিনেক আগেও বহু পুজো কমিটি ভেবেছিল এবার ঘট পুজো ইহবে।তাই কাশীবোস লেনে ঘটই বানিয়েছি।ভেষজ জিনিস এবং বাজারে খুব কম দামে পাওয়া যায়, এমন সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে।দর্শনার্থীরা এবার দেখবেন, সীমিতের মধ্যেই কীকী করা যায়।”
আরও পড়ুন: পড়ার ফাঁকে পাড়ার ঠাকুর গড়ছে হেতমপুরের শুভম
সন্তোষমিত্র স্কোয়ারের থিম-শিল্পী বিপ্লব রক্ষিত বললেন, “মানুষ এখন ঘুরতে যেতে পারছেন না।বিনা পয়সায় আমরা তাই বদ্রীনাথ ধাম দেখাব।১৫ বছর ধরে এই পুজোয় কাজ করছি।শিল্পী নয়, সদস্যই হয়ে গিয়েছি। পুজো বাঁচিয়ে রাখা একজন শিল্পীরও কর্তব্য।” এই কর্তব্যে তিনিও শরিক হয়েছেন বলে জানালেন টালা বারোয়ারির থিম-শিল্পী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। ১০০তম বছরে সেখানে ভারতীয় সেনাকে উৎসর্গ করে থিম করা হচ্ছে।শিল্পী বললেন,“সঙ্গে থাকা কর্মীরা কাজ পাবেন এই ভেবেই এগোনো।”
বড়িশা সর্বজনীনের থিম-শিল্পী দেবাশিস বাড়ুই আবার বল ছিলেন, “কিছু নেইয়ের এক ওয়ার্কশপে বাংলা দেশে কচুরিপানা দিয়ে কাজ করে ছিলাম।আসলে প্রতিকূলতা টপকে কিছু করার নামই শিল্প।এবারওসেই শিল্পেরই জয় হবে।”