দুর্গাপুজো নিয়ে আমার কোনও দিনই খুব একটা উৎসাহ ছিল না। পুজো হয়, হই হই রই রই হয়। ঠাকুর দেখা, বিজয়ায় কোলাকুলি, নাড়ু-তক্তি-মোয়া সাঁটানো, সবই ভাল লাগত। কিন্তু একটু আলগা ভাবও ছিল। আড়ম্বর, জাঁকজমক, বাদ্যি-বাজনা আমায় তত টানে না। আমি আবার ভিড়-ভীত মানুষও। অতিরিক্ত জনসমাগম আমার পক্ষে অস্বস্তিকর। তবু ছেলেবেলায় এক রকম সয়ে যেত বন্ধুবান্ধবরা সঙ্গে থাকত বলে। কিন্তু বড় হওয়ার পরে পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটা প্রকট হয়েছে ।
তবে পুজোর হই-হট্টগোলের মধ্যেও যে জিনিসটা আমাকে চুম্বকের মতো টানত, তা হল শরৎ ঋতু। শরৎকাল মানেই কাশফুল, আকাশের ফিরোজা রং আর সাদা ছেঁড়া মেঘ, শিউলি ফুল তো! লোকের আহ্লাদ তো তা নিয়েই। হ্যাঁ, শরতের অপরিহার্য এ সব মালমশলা তো আছেই, তবু তার ম্যাজিকটা আরও একটু গভীর। সেটা হয়তো শুধু আমারই কাছে। আমি বহু বার বহু প্রসঙ্গে বলেছি, শরৎ হল আমার পাগল হওয়ার সময়। আমার শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনেরও অনেকটা সময় কেটেছে দূর সব জনপদে। পাহাড়-জঙ্গলে আকীর্ণ পটচিত্রের মতো সু্ন্দর অসমে, দূরন্ত ভূপ্রকৃতির বিহার কিংবা স্নিগ্ধ হিমালয়ের কোলে উত্তরবঙ্গে অথবা ঘনীভূত সবুজের অকৃপণ সমারোহে পূর্ববঙ্গে। কলকাতায় শরৎ ঢুকতে পথ পায় না, একটু উঁকিঝুঁকি দিয়েই পালায়। কিন্তু আমার শৈশবের চারণভূমিতে সে ছিল স্বরাজ্যে স্বরাট।
বর্ষা গুটিয়ে নিচ্ছে তার জলের চাদর, বাতাসে গ্রীষ্মকে রুমাল উড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছে উত্তুরে বাতাস, মেঘে ছানা কেটে ঝকঝকে নীল জলে মুখ ধুয়ে নিচ্ছে আকাশ। এই সময়ে সন্ধের মুখে ছাতিম ফুলের মাদক গন্ধে বাতাস মাতাল হয়ে যায়। কিন্তু এ সবও নয়, আমাকে পাগল করে দেয়, আজও দেয়, শরতের চোরা এক অচেনা সম্মোহন। বরাবর দেখে এসেছি, শরৎ আমার চেনা দুনিয়াটাকেই যেন জাদুবলে পাল্টে দিয়েছে। আমি যেন আমার চেনা জগৎটাকে কিছুতেই আর চিনতে পারি না। আমার স্বভাবগত বিষাদঝোঁকা মন একমাত্র শরৎকালেই ফুল্ল হয়ে ওঠে। কথাটা কাউকে ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারিনি যে কেন এটা হয়। শুধু জানি, বছরের ঠিক এই সময়টুকু আমার ভারি ভাল কাটে। ক’টা মুষ্টিভিক্ষার মতো দিন ।
তা বলে দুর্গাপুজোকে অমান্যি করি কী করে! সে-ও তো জীবনের সঙ্গে নানা বিভঙ্গে জড়িয়ে আছে। এক বার পুজোর কিছু দিন আগে আমি সস্ত্রীক লন্ডনে। বাংলাদেশি একটি সংস্থার আমন্ত্রণে। নানা অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া, বক্তৃতা দেওয়া, সামাজিক নেমন্তন্ন রক্ষা করা, আর তারই ফাঁকে ফাঁকে ব্রিটিশ মিউজিয়াম, শেক্সপিয়রের বাড়ি, মাদাম তুসো, ব্রিক লেনের বাঙালি পাড়া ঘুরে ঘুরে সময় কেটে যাচ্ছিল। খেয়ালই ছিল না যে, পুজো এসে গেছে প্রায়। আমরা তখন থাকি এক সজ্জন বিবাহবিচ্ছিন্ন বাঙালির বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে। সেখানে রীতিমতো আড্ডার পরিবেশ। সেখানেই এক দিন এক সহাস্যমুখ, সদাশয়, মাঝবয়সি ভদ্রলোক হানা দিয়ে বললেন, আমার নিজের একটা পুজো আছে, আমি নিজেই পৌরোহিত্য করি। খুব শাস্ত্রসম্মত ভাবেই করার চেষ্টা করি। আপনাকে সস্ত্রীক এক বার যেতেই হবে। আমি প্রমাদ গুনলাম, কারণ আমাদের ফেরার সময়ও তখন আগতপ্রায়। হিসেব করে দেখলাম, আমাদের ফ্লাইটের দিন মহাষ্টমী। শুধুমাত্র সপ্তমীর দিনটাই হাতে আছে, কিন্তু সেটা তো কিছু কেনাকাটা আর গোছগাছের জন্য ধরে রাখতে হবে। কিন্তু মানুষটি নাছোড়বান্দা। আমাকে রাজি করিয়ে তবে উঠলেন। কথাবার্তায় বোঝা গেল, এই মানুষটি দুর্গাপুজোকে কতটা গুরুত্ব দেন। অমন নিষ্ঠাবান মানুষ নাকি বিরল, সবাই একমত হয়ে বললেন। যথারীতি সপ্তমী পুজোর দিন আমাদের গৃহকর্তা দুপুরের খাওয়ার পরেই আমাদের নিয়ে রওনা হয়ে পড়লেন। লন্ডনে তখন বেজায় শীতও পড়ে গেছে। দুপুরেও জ্যাকেট চাপিয়ে যেতে হল।
আরও পড়ুন: মা দুগ্গা আসবেন, তাই ঝেড়েপুঁছে সেজে উঠত ঘরদোর
একটা ভারি সুন্দর সবুজে সবুজ মস্ত খেলার মাঠ, তারই এক কোণে ছিমছাম একটি বেশ বড়সড় ক্লাবঘর। সেই ক্লাবেরই বিরাট বড় হলঘরে পুজোর আয়োজন। মূর্তিটি সম্ভবত ফাইবার গ্লাস বা প্লাস্টার অব প্যারিসে তৈরি। ছোটখাটো। সেখানে থিকথিক করছে শাড়ি ও ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সুবেশা ও সুবেশ বাঙালি মহিলা এবং পুরুষ। কয়েক জন প্রবাসী অবাঙালিও ছিলেন বলে মনে হচ্ছে যেন। ঢাকের বাদ্যি নেই বটে, তবে কাঁসরঘণ্টা ছিল। সঙ্গে ধূপধুনো, পরিষ্কার উচ্চারণে সংস্কৃত মন্ত্রপাঠ। কী বলব, ভারি ভাল লাগছিল পরিবেশটি। মনে হচ্ছিল, যেন এই বাংলাতেই একটা ঘরোয়া পুজো দেখছি। শুধু একটু তফাত লাগছিল প্রণামীর থালায় টাকার বদলে পাউন্ড আর শিলিং-এর স্তূপ দেখে। বাঙালির সেই প্রবাসী পুজোর আড্ডায় আমরা একেবারে জমে গিয়েছিলাম, মনে আছে। তরতর করে সময় কেটে গিয়েছিল। ভিজে গিয়েছিল মন। আর বলা বাহুল্য, বিদেশের ভেজালহীন উৎকৃষ্ট মালমশলায় তৈরি সু্স্বাদু ভোগটিও ছিল উপভোগ্য।