আকাশে রোদের রং পালটে গেলেই বুঝি পুজো আসছে।
পুজো? কোন পুজো?
আরে, এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি? আমাদের বারো মাসে তেরো পার্বণ থাকলেও পুজো বলতে তো আমরা দুর্গাপুজোকেই বুঝি! সেই ছোট থেকে পুজো বলতে আমরা আর কিছু বুঝতে শিখিনি তো!
ঠাকুর গড়া দেখতাম, দেখতাম সদ্য শাড়ি পরা কিশোরীটিকেও
আসলে যত বার পুজো আসে তত বার আমার ছোটবেলার কথাই মনে পড়ে! সেই ছোটবেলা, যেখানে আকাশটা অনেক বেশি নীল ছিল! যেখানে সামান্য হজমিগুলির মধ্যে আমরা খুঁজে পেতাম আনন্দ! যেখানে বন্ধুকে অনায়াসে দিয়ে দেওয়া যেত অরণ্যদেব আর ম্যানড্রেকের কমিক্স! সেই ছোটবেলা যেখানে আমাদের ঘিরে থাকত বাবা, মা, দাদু, ঠাকুমা আর পিসি, কাকারা! মনে পড়ে, তাদের শাসনে আর ভালবাসায় কাটানো পুজোর সেই হাওয়া মিঠাইয়ের মতো দিনগুলো!
আজ যখন সেই খেলা ভেঙে গিয়েছে, যখন সেই ছোট ছোট আনন্দগুলো কোথাও নেই, নেই সেই সব মানুষগুলো যাদের কোল ঘেঁষে অনায়াসে ঘুমিয়ে পড়া যেত, তখন যেন আরও বেশি করে মনে পরে ছোটবেলার পুজোর স্মৃতি!
আমার ছোটবেলার একটা অংশ কেটেছে মফসসলে। গঙ্গার পাড়ের সেই ছোট্ট শহরটা ছিল রোদ ঝলমলে ছবির মতো সুন্দর! চওড়া কালো রাস্তা। বড় বড় সবুজ মাঠ! সিনারির মতো ছোট্ট ব্রিজ! আর রাস্তার দুপাশে ক্রেয়নে আঁকা গুলমোহর আর রেন ট্রি-র সারি। দূরে দূরে পাম গাছে ঘেরা অদ্ভুত সুন্দর সব লালা সাদা কোয়ার্টার!
এমন মফস্সলে পুজোটাও হত দারুণ! আকারে ছোটখাটো আট-দশটা পুজোর পাশাপাশি বড় পুজো ছিল দুটো। সেই দুটো পুজোর জন্য তৈরি করা চাতাল ছিল। তাতে ঢালা প্যান্ডেল হত। আর ছিল প্যান্ডেলে স্টেজ! পুজোর চার দিন যাত্রা হবে যে!
সেই প্যান্ডেলে ঠাকুরও হত বিশাল বড়। আমরা পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে দেখতাম ঠাকুরের মুখ। তার ঝলমলে কাপড়! ঠাকুরের হাতে ধরা চকচকে অস্ত্রশস্ত্র দেখে কেমন যেন ঢিপঢিপ করত বুক! গর্জন তেল মাখা মহিষাসুরকে দেখে কেন জানি মনে হত, এ জ্যান্ত হয়ে গেলে কী যে হবে! আসলে তখনও তো বুঝিনি, বড় হয়ে এই সমাজেই কত মুখোশ ঢাকা মহিষাসুরকে রোজ সামলাতে হবে!
তবে পুজোর আসল মজা ছিল মেলায়! ওই যে বড় বড় মাঠের কথা বলেছিলাম না, সেখানেই মেলা বসত! আর কী না থাকত তাতে! নানা রকম নাগরদোলা আসত। কাঠের হাতে টানা থেকে মেরি-গো-রাউন্ড, ইলেকট্রিকের বড় নাগরদোলা, মানে এখন যাকে জায়ান্ট হুইল বলতে শিখেছি আর কী, সেই সব আসত। এ ছাড়াও আসত মরণকূপ, পুতুলনাচ, আয়না ঘর, বেলুন ফাটানো, চিড়িয়াখানা, অদ্ভুত মানুষ থেকে শুরু করে বোটিং, টয় ট্রেন, সার্কাস! আরও কত কী মজার ব্যাপার যে বলার বাইরে থেকে গেল!
আরও পড়ুন: বদলে গেছে পুজোর রং, আমার বুকে আজ আর তোলপাড় নেই: অর্পিতা
এর মধ্যে সার্কাসের মাঠ ছিল আলাদা। আমরা প্রতি বার ভাবতাম, এ বার কত খুঁটির সার্কাস আসবে! যত বেশি খুঁটি তত বড় সার্কাস!
সকালবেলা আমরা সার্কাসের তাঁবুর কাছে যেতাম। তখন গেট বন্ধ থাকলেও হাতিদের নিয়ে মাহুতরা বেরত ঘোরাতে। আমরাও তাদের পাশে পাশে হাঁটতাম! আমাদের কাছে দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ ছিল এই হাতিদের একদম কাছ থেকে দেখা! তাদের শুঁড় ছুঁয়ে আদর করা। আবার সন্ধেবেলা এই সার্কাসের জায়গা থেকে বড় দুটো সার্চলাইট মারা হত আকাশে। আমরা মফস্সলের যেখানেই থাকি না কেন, দেখতাম সেই আলোর লাঠি দুটো আকাশে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে!
আর ছিল খাবারদাবারের স্টল! সেই আশির দশকে এখনকার মতো এত রকম খাবার পাওয়া যেত না। তা-ও পুজোর সময়, মোগলাই পরোটা, চাউমিন, ডিমের ‘মামলেট’ দিয়ে হাফ রুটি, ঘুগনি, ফুচকা আর ফিশ ফ্রাই ছিল খাবারের মূল আকর্ষণ!
নানান ক্লাবের সঙ্গে ইয়ং ছেলেরা দিত কোল্ড ড্রিঙ্কের স্টল। আর স্টলের সামনে দিয়ে গেলে প্রায় কোলে করে তুলে নিয়ে গিয়ে স্টলে বসিয়ে হাতে ঠান্ডা পানীয়ের বোতল গুঁজে দেওয়া হত! কোনও ওজর আপত্তি শোনা হত না! তবে এ সবের বাইরে আমার কাছে সবচেয়ে পছন্দের ছিল আচার!
মনে আছে বড় প্যান্ডেলের বাইরে সকালবেলা লক্ষ্মীদা বসত আচারের ডালা নিয়ে! কুল, চালতা, কয়েতবেল থেকে শুরু করে কত রকমের যে আচার ছিল তার ঠিক নেই। আমার মনে মনে ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে লক্ষ্মীদার মতো আচারওয়ালা হব। কত আচার খেতে পারব সারাক্ষণ! কিন্তু অনেক ইচ্ছের মতো এটাও অপূর্ণ থেকে গেল এই জীবনে!
এগারো বছর বয়সে আচমকা মফস্সলের পাট গুটিয়ে আমরা কলকাতায় চলে এসেছিলাম! তার সঙ্গে সব কিছুই কেমন যেন পাল্টে গিয়েছিল জীবনের। আর দুর্গাপুজো যেহেতু জীবনের বাইরের কিছু নয়, তাই সেই পুজোও কেমন যেন বদলে গিয়েছিল!
শহরে সে ভাবে মাঠ নেই! রাস্তা আটকে পুজো হয়! চাঁদার জন্য চাপাচাপি করা হয়। সব জায়গায় মেলাও বসে না! কোনও বড় পার্ক বা মাঠের মতো আছে যেখানে, সেই সব জায়গাতেই শুধু মেলা বসে। তা-ও সে মেলা আমার মফস্সলের মেলার মতো নয়। সেই খোলামেলা ব্যাপারটাই যেন নেই!
তার উপর ভিড়! বাঁশের ব্যারিকেড! পুলিশের শাসন! কলকাতায় এসে আমি প্রথম বুঝেছিলাম পুজোর ভিড় কাকে বলে! মনে আছে এক বার সেই ভিড়ে ন’কাকার সঙ্গে বেরিয়ে আমার কী রকম হাঁফফাঁস অবস্থা হয়েছিল!
আর যেটা ভীষণ ভাবে মনে ক্ষত তৈরি করেছিল, তা হল দারিদ্র! শহরে এত গরিব মানুষ থাকে! সদ্য এগারো বছরে পা দেওয়া আমায় এই দুর্গাপুজোই যেন প্রথম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল সমাজের এই দিকটা!
দেখেছিলাম চকচকে জামাকাপড় আর মেক-আপ ঢাকা মানুষদের পাশেই তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছায়া-ছায়া, ছেঁড়া জামা আর উড়োখুড়ো চুলের মানুষজন, বাচ্চারা। এদের সবার চোখে কেমন একটা হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টি! আমার মনে হত তারা যেন মনে মনে প্রশ্ন করছে, এত আলোর মাঝেও আমাদের জীবনে এমন অন্ধকার কেন!
এই পুজোতেই আমি দেখেছিলাম কলকাতার ফুটপাতে সপ্তমীর সন্ধ্যায় একটি ছোট্ট শিশুকে। ছেঁড়া প্যান্ট পরে হাতের মুঠোয় একটা ফাটা বেলুন আঁকড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে!
কত দিন আগে দেখা সেই দৃশ্য, তবু আজও, এত বছর পরেও আমি তা ভুলতে পারি না। পুজো এলে ছোটবেলার অনেক ঝিলমিল স্মৃতির সঙ্গে এই মনখারাপ করে দেওয়া ছবিটাও মনে পড়ে আমার।
বড় হওয়ার সঙ্গে পুজো পাল্টে গিয়েছিল ক্রমে। একা একা রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে শুরু করার পরে আমি আবার পুজোর দিনগুলোয় ফিরে যেতে শুরু করেছিলাম আমার সেই মফসসলেই। সেখানেই যে সব আত্মীয় আমার, সেখানেই যে সব বন্ধু!
তবে ছোটবেলার সেই কটন ক্যান্ডি আর আচারের পুজোটা আর ফিরে আসেনি। জীবনের চাহিদা আর অ্যাম্বিশন বাড়ার সঙ্গে আনন্দগুলো কেমন যেন একটু একটু করে জল মেশানো দুধের মতো হয়ে গিয়েছে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় ওই তো সাদা রং। কিন্তু খেলে বোঝা যায় কোথায় যেন সেই স্বাদ আর নেই!
এখন আমার কাছে পুজো মানে, ছুটি। পুজো মানে বাড়ি থেকে কোথাও না বেরিয়ে সারাদিন নিজের মতো বই পড়া।
তবু শহরের নানান গলিতে যখন বাঁশ পড়ে, কাপড় আর ত্রিপল টাঙানো শুরু হয়! যখন দোকান বাজার আর শপিং মলে লোকজন ভিড় করতে থাকে! আর এই সবের থেকে অনেক ওপরে ওই আকাশে যখন রোদের রং পাল্টে যায়, বুঝি, আবার পুজো এল! আর মনে পড়ে ছোটবেলার কথা!
ঘুম ভাঙার সেই আধো আবছায়ায় মনে হয়, মা বোধহয় ডাকবে এই বার, বলবে ওঠ, আজ অষ্টমী যে! অঞ্জলি দিতে যাবি না!
না, মা বহু দিন আর নেই। অধিকাংশ প্রিয় মানুষজনই আর ফিরে আসবে না কোনও দিন। লক্ষ্মীদাও আর কোনও দিন আচারের ডালা নিয়ে বসবে না কোনও বিশাল প্যান্ডেলের পাশে! তবু জানি, পুজো এলে তারা আসবেই! ফুটে উঠবেই স্মৃতির সমস্ত রোদ্দুর জুড়ে! আর ঝরে পড়বে শিউলি আর ছাতিম হয়ে আমার মনের ওপরে চিরদিন! বুঝি, এমন অঞ্জলি একমাত্র শরতের পক্ষেই বোধহয় সম্ভব!
অলঙ্করণ- তিয়াসা দাস