সুরুল রাজবাড়ি
শহরের জাঁকজমক থেকে একটু দূরে লাল মাটি আর সবুজে ঘেরা বীরভূমের সুরুল গ্রামে। সেখানেই রাজবাড়ির পুজোয় প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে হাজির হন অজস্র মানুষ। ৩০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে। এ বার পুজোয় আপনিও কিন্তু ঘুরে আসতেই পারেন। ডুব দিতে পারেন তিন শতকের রাজকীয় আমেজে। কলকাতা থেকে আর কতই বা দূর!
পুজোর ক’দিন আলোয় আলো হয়ে থাকে গোটা রাজবাড়ি। সুরুলে সরকার বাড়ির পুজো নামে খ্যাত এই শারদোৎসবে এক সময়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বহু গুণী জনের আনাগোনা ছিল। সারা বছর যেমনই থাক, পুজোর দিনগুলোয় একেবারে অন্য সাজে সেজে ওঠে এই রাজবাড়ি।
সুরুল রাজবাড়ির ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে বর্ধমানের নীলপুর থেকে ভরতচন্দ্র সরকার এই গ্রামে পা রাখেন। প্রথমে এখানকার বাসিন্দা বাসুদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। তার পরে গড়ে তোলেন নিজের বসতবাড়ি। ভরতচন্দ্রের আমল থেকেই এ বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু। তাঁর পুত্র কৃষ্ণহরির সন্তান শ্রীনিবাস ইংরেজদের সঙ্গে নানা ব্যবসার কাজে যুক্ত ছিলেন। সেই সূত্রে সাহেব মহলে বেশ খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেন তিনি। জাহাজের পাল তৈরির কাপড় এবং নীল চাষের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন শ্রীনিবাস। অনেকে বলেন, এই পরিবারের সরকার পদবীও নাকি ইংরেজদের দেওয়া, তাদের আসল পদবী ছিল ঘোষ।
এক সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গেও খুব ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই সরকার বাড়ির। শোনা যায়, সেই সূত্রে মহাত্মা গান্ধীকে নিয়েও নাকি এই রাজবাড়িতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এক সময়ে এই রাজবাড়ির থেকে শান্তিনিকেতনের জন্য অনেক জমি পেয়েছিল ঠাকুর পরিবার– শোনা যায় এমন কথাও।
সুরুল রাজবাড়ির দুর্গাপুজো খুবই জনপ্রিয় তার অনন্য রীতির কারণে। রথের দিন থেকেই এখানে শুরু হয় প্রতিমা গড়া। এখানে দুর্গাকে দেখা যায় ডাকের সাজে। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় প্রতিমার হাতে। পুজোর দিনগুলোয় সাজানো হয় পারিবারিক সোনার গয়নায়। শারদীয়ার শুরু থেকেই সুদূর বেলজিয়াম থেকে আনা নজরকাড়া ঝাড়বাতির আলোয় সেজে ওঠে রাজবাড়ির প্রতিটি অংশ। যে বিষয়টি সবার নজর কাড়ে, তা হল– রাজবাড়িতে পুজোর ক’দিন কোনও রকম বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার হয় না। গোটা রাজবাড়ি আলোকিত হয় মোমবাতির নরম আলোয়।
সপ্তমী থেকে নবমী প্রত্যেক দিনই বলি দেওয়া হয় এই পুজোয়। দুর্গা ছাড়াও একত্রে পুজো পান নারায়ণ। বলির সময়ে নারায়ণকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। বলি হয়ে গেলে তিনি ফিরে আসেন মূল গর্ভগৃহে। বিরাটাকার থামে ঘেরা নাটমন্দির ও দালান ঘিরে সন্ধেবেলায় বসে যাত্রার আসর। গ্রামের প্রতিটি মানুষ সানন্দে শরিক হন ৩০০ বছরের বেশি বয়সী এই পুজোর উদযাপনে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।