লাল মেঝেতে সাদা আলপনার চল অতি প্রাচীন।
লক্ষ্মীপুজো মানে বাংলার ঘরে ঘরে আলপনা। লাল মেঝেতে খড়িমাটি বা চালের গুঁড়োর শ্বেতশুভ্র আলপনার চল অতি প্রাচীন। লক্ষ্মীঠাকুরের আরাধনায় জাঁকজমক থাকে না, থাকে ঘরোয়া আয়োজন। শাঁখ-উলুধ্বনিতে গৃহকর্ত্রীর হাতেই পূজিত হন দেবী। ধূপ-ধুনো-প্রদীপ জ্বেলে অত্যন্ত ঘরোয়া উপায়ে ছিমছাম পুজো সারা হয়।
কথিত আছে, যে ভক্ত সারা রাত নিষ্ঠাভরে জেগে থাকেন দেবীর অপেক্ষায়, দেবী তাঁর ঘর আলো করে আসেন। চুপচাপ তিনি পুজোর ঘরে প্রবেশ করেন চৌকাঠ পেরিয়ে। লক্ষ্মীর পায়ের প্রতীকী ছাপও তাই থাকে আলপনায়। হাঁটার সময়ে দু’ধারে ছড়িয়ে দেন ধানের শিষ, যা ধন-সম্পত্তির প্রতীক। লক্ষ্মী-আরাধনায় থাকে সারা বাংলার জন্য মঙ্গলকামনা— মা লক্ষ্মী যেন সকলের ঝাঁপি পূর্ণ করেন! আলপনায় থাকে এই ধানও।
আলপনার নকশায় এই ভাবে মিলেমিশে আছে বহু আচার, বিশ্বাস, লোককথা। কেবল গৃহসজ্জার অঙ্গ নয় এটি। জনপ্রিয় নকশাগুলির মধ্যে কোনগুলি পড়ে?
১) লক্ষ্মীর পা ও ধানের শিষ: কোজাগরী, অর্থা়ৎ ‘কে জাগে রে?’ যে জেগে থাকবে তার ঘরে মা লক্ষ্মী আসবেন পায়ে হেঁটে, ছ়ড়িয়ে যাবেন ধান। তাই আলপনায় এই লক্ষ্মীর পা ও ধানের নকশা থাকবেই। সাধারণত লম্বা আঁকাবাঁকা রেখায় ধান আঁকা হয়, তার চারপাশে থাকে ধানের শিষ। আর তার দু’পাশেই শোভা পায় মা লক্ষ্মীর পা। এটি আঁকা হয় ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের ধাঁচে। তার উপর পাঁচটি বিন্দুতে বোঝানো হয় পাঁচ আঙুল।
২) মাছ: কোজাগরী মূলত পূর্ব বঙ্গের মানুষদের লক্ষ্মীপুজোর দিন। অনেকে এই দিন মা লক্ষ্মীকে ইলিশ মাছ উৎসর্গ করেন। সেই চলের প্রতিফলন দেখা আলপনাতেও। মাছ বেশ কিছু আলপনার নকশায় থাকে।
মাছ বেশ কিছু আলপনার নকশায় থাকে।
৩) শঙ্খ-পদ্ম-চক্র: মা লক্ষ্মী ঢাক-ঢোলের আড়ম্বর পছন্দ করেন না। তাই তাঁর আরাধনায় কেবল শঙ্খধ্বনিই থাকে। দেবীর হাতে থাকে পদ্ম। আলপনাতেও এই দু’টি থাকে প্রতীক হিসাবে।
৪) ফুল-লতা-পাতা: পুজোর নৈবেদ্য ফুল ছাড়া ভাবা যায় না। মা লক্ষ্মী নিজেও পদ্মফুলের উপরেই অধিষ্ঠাত্রী। লক্ষ্মীপুজোয় তাই পদ্ম ফুলই বেশি উঠে আসে আলপনার নকশায়। তবে ফুল-লতা-পাতা মিলিয়ে অনেক সূক্ষ্ম নকশা দেখা যায় আলপনায়।
৫) পেঁচা: মা লক্ষ্মীর বাহন হল পেঁচা। তিনি আসেন পেঁচায় চড়ে, তাই তার নামও লক্ষ্মীপেঁচা। পেঁচা শুভ কাজের প্রতীক। লক্ষ্মীপুজোর আলপনাতে তাই পেঁচা আর একটি জনপ্রিয় প্রতীক হিসাবে থাকে।
আলপনার আকার—
লক্ষ্মীপুজোর ক্ষেত্রে আলপনা শুরু হয় দরজা থেকে, কারণ তুষ্ট হলে দরজা দিয়ে চৌকাঠ পেরিয়ে দেবী আসেন। সেই চৌকাঠের চার পাশে আঁকা থাকে দেবীর পা ও ধানের ছড়া। সাধারণত ছোটর মধ্যে লম্বাটে হয় এই আলপনাগুলি। লক্ষ্মীর পা আঁকা থাকে ঘট বা প্রতিমা পর্যন্ত। ঘটের সামনে থাকে মূল আলপনা। সেটি চক্রাকার হয়। তবে এখন চৌকো ধরনের আলপনাও আঁকা হয়।
দরজার সামনে ছোটর মধ্যে লম্বাটে আলপনা দেওয়া হয়।
কী ভাবে দেবেন?
মূলত চালের গুঁড়ো জলে গুলে আলপনা দেওয়া হয়। অথবা, অনেকে খড়িমাটিও ব্যবহার করেন। তুলো ব্যবহার করে হাত দিয়েই দেওয়া হয় এই আলপনা। তবে এই দুই ধরনের আলপনার একটিও বেশি দিন থাকে না। এর ঔজ্জ্বল্যও কম। বেশি দীর্ঘমেয়াদী ও উজ্জ্বল আলপনার জন্য বর্তমানে অনেকে অ্যাক্রিলিক রং ব্যবহার করেন। সে ক্ষেত্রে তুলি ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে লাল মেঝে বা সিমেন্টের ধূসর মেঝেও খুব একটা দেখা যায় না। বাঙালির বাস এখন ফ্যাটেই। তাই মেঝেতেও হয় মোজাইক, না হয় মার্বেল। সাদা মেঝেতে সাদা আলপনা ভাল ফোটে না। তাই লাল বা হলুদের মতো উজ্জ্বল রং ব্যবহার করতে পারেন। আলপনার বদলে সে ক্ষেত্রে রংগোলি দেওয়াই শ্রেয়।
কোথা থেকে দেবেন?
আলপনা দেওয়ার জন্য নকশার বই পাওয়া যায়। সেই বই কিনে আলপনা দিতে পারেন। তবে এখন নেটমাধ্যমেও আকছার মেলে আলপনা দেওয়ার ভিডিয়ো। সেখান থেকেও নিজের পছন্দ মতো আলপনা দিতে পারেন।