শরতে দেবী দুর্গার আবাহনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষিপ্রধান সভ্যতার উর্বরতার প্রতীকও। বাঙালিদের কাছে দশভুজা সপরিবার পূজিত হলেও দেশের অন্য অংশে তিনি একাই আসীন সিংহাসনে।
আমাদের শারদোৎসবের সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাড়ম্বরে পালিত হয় নবরাত্রি। দেবীপক্ষের মধ্যে টানা ন’দিন ধরে পুজো করা হয় দুর্গা বা পার্বতীর ন’টি অবতারকে।
নবরাত্রির প্রথম দিন পূজিত হন শৈলপুত্রী। এখানে তিনি শৈল অর্থাৎ হিমালয়ের কন্যা। পর্বতের কন্যা বলে তাঁর আর এক নাম পার্বতী। আবার গিরি থেকে জন্ম বলে তিনি গিরিজা।
সাধারণত শৈলপুত্রীর বিগ্রহকে কল্পনা করা হয় দু’টি হাত বিশিষ্ট রূপে। তাঁর ডান হাতে রয়েছে ত্রিশূল। বাঁ হাতে পদ্ম। মহাদেবের ষাঁড় নন্দী তাঁর বাহন।
নবরাত্রির দ্বিতীয় দিনে দেবী পূজিত হন ব্রহ্মচারিণী রূপে। পুরাণে কথিত, দক্ষ প্রজাপতির কন্যা উমা তপস্যা করেছিলেন মহাদেবকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য। তাই তিনি কুমারী এবং ব্রহ্মচারী। এই রূপে তাঁর অপর নাম অপর্ণা। এই রূপে দেবীর ডান হাতে থাকে জপমালা ও বাঁ হাতে ধরে থাকেন কমণ্ডলু।
বিবাহের পরে স্ত্রী উমার কপালেও এক ফালি চাঁদ যোগ করেছিলেন মহাদেব। সেই চাঁদ যেন দেবীর কপাল ঘণ্টার মতো স্পর্শ করে থাকে। তাই তিনি চন্দ্রঘণ্টা। দেবী এই রূপে দশভুজা। দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনে রত তিনি।
তাঁর ডান দিকের চার হাতে থাকে পদ্ম, কমণ্ডলু এবং জপমালা। পঞ্চম হাতে তিনি ভক্তদের অভয়মুদ্রা প্রদর্শন করেন। বাঁ দিকের প্রথম চার হাতে শোভা পায় ত্রিশূল, গদা, তরবারি, তির ও ধনুক। পঞ্চম হাতে ভক্তদের জন্য বরদামুদ্রা। তাঁর বাহন বাঘ।
‘কুষ্মাণ্ড’ রূপে দেবী বাস করেছিলেন সূর্যের অভ্যন্তরে। তাঁর মধ্যে দিয়েই সূর্যের তাপ প্রকাশিত হয়েছিল মহাবিশ্বে। নবরাত্রির চতুর্থ দিনে দেবী দুর্গা পূজিত হন ‘কুষ্মাণ্ড’ অবতারে।
আট হাত বিশিষ্ট দেবী কুষ্মাণ্ড সিংহের পিঠে আসীন। তাঁর হাতে কমণ্ডলু, ধনুক, গদা, চক্র, পদ্ম এবং জপমালার পাশাপাশি আছে অমৃতকলস। তাঁর হাসি থেকেই নাকি এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি। তিনি ভক্তদের শ্রী ও সম্পদ দান করেন।
নবরাত্রির পঞ্চম দিনে পূজিতা হয় দেবীর স্কন্দমাতা রূপ। বাহন সিংহের পিঠে আসীন দেবীর সঙ্গে থাকে শিশু কার্তিকের বিগ্রহ। কার্তিকের আর এক নাম স্কন্দ। তার থেকেই নাম স্কন্দমাতা।
ডান হাতে তিনি ধরে থাকেন শিশু কার্তিকেয়কে। প্রশস্ত বাঁ হাতে থাকে অভয়মুদ্রা। পদ্মে উপবিষ্ট দেবীকে বলা হয় পদ্মাসনাও। বলা হয়, স্কন্দমাতার উপাসনা করলে দেবসেনাপতি কার্তিকের আশীর্বাদও পাওয়া যায়।
পার্বতী একবার ঋষি কাত্যায়নের কন্যা রূপেও জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেই সূত্রে তাঁর নাম হয় কাত্যায়নী। সিংহবাহিনী এই দেবীর দুই হাতে ধরা থাকে পদ্ম এবং তলোয়ার। বাকি দুই হাতে ভক্তদের জন্য অবারিত অভয়মুদ্রা ও বরদামুদ্রা। নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে পূজিত হন দেবী কাত্যায়নী।
দুর্গার ভয়ঙ্করতম অবতার কালরাত্রি পূজিত হয় সপ্তম রাত্রে। কালরাত্রি শব্দের অর্থ হল মৃত্যুর রাত। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ এই রূপে তিনি বধ করেছিলেন শুম্ভ ও নিশুম্ভকে।
চার হাত বিশিষ্ট দেবীর এই অবতার আসীন তাঁর বাহন গাধার পিঠে। তাঁর ডান দিকের দুই হাতে বরদা ও অভয়মুদ্রা থাকলেও বাঁ দিকের দুই হাতে ধরা থাকে তরবারি ও লৌহবজ্র।
রাতের পরে যেমন দিন আসে, ঠিক তেমন কালরাত্রির পরে আবির্ভূত হন দেবী দুর্গা, তাঁর মহাগৌরী রূপে। তিনি শুদ্ধতা ও পরিচ্ছন্নতার প্রতীক। নবরাত্রির অষ্টম দিনে তিনি পূজিত হন।
শৈলপুত্রী অবতারের মতো মহাগৌরীর বাহনও ষাঁড়। চার হাতবিশিষ্ট দেবীর ডান দিকের এক হাতে ধরা থাকে ত্রিশূল। অন্য হাতে তিনি অভয়মুদ্রা ধারন করেন ভক্তদের জন্য।
মহাগৌরী বাঁ দিকের দুই হাতের একটিতে ধরে থাকেন মহাদেবের ডমরু। অন্য হাতে শুধুই বরদামুদ্রা। কালরাত্রি যদি ধ্বংস ও বিনাশের প্রতীক হন, মহাগৌরী তবে ক্ষমার প্রতিভূ।
নবরাত্রির শেষ তথা নবম দিনে পূজিত হন মা দুর্গার সিদ্ধিদাত্রী অবতার। সৃষ্টির মূল আদি পরাশক্তি হিসেবে তাঁর আবির্ভাব মহাদেবের অর্ধাংশ থেকে।
পদ্মাসনা সিদ্ধিদাত্রীর বাহন বাঘ অথবা সিংহ। তাঁর ডান দিকের হাত দুটিতে ধরা থাকে গদা ও চক্র। বাঁ হাতে ধরে থাকেন শঙ্খ ও পদ্ম। দেব-গন্ধর্ব, মানব এবং অসুর, এই তিন লোকেই পূজিত হন দেবী সিদ্ধিদাত্রী।
এই ভাবে ন’টি আলাদা আলাদা রূপে পূজিত হন দেবী দুর্গা। ভক্তদের কল্পনায় তিনি ধরা দেন বহু রূপে।