‘বড় হতেই আমি অর্থাৎ, অমৃতা চট্টোপাধ্যায়ের পুজোয় শুধুই শহর কলকাতা জায়গা করে নিয়েছে।’
আমার ছোটবেলার পুজোয় গ্রাম আর শহর সমান্তরাল ভাবে ছিল। সপ্তমী পর্যন্ত কলকাতায় থেকে চুটিয়ে আনন্দ। সেই রাতেই বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে পরের দিন গ্রামে দেশের বাড়িতে। সেখানে অষ্টমীর অঞ্জলি ছিল। দশমীর ভাসান ছিল। আর ছিল লক্ষ্মী পুজো। সব মিলিয়ে লম্বা ছুটি। বড় হতেই আমি অর্থাৎ, অমৃতা চট্টোপাধ্যায়ের পুজোয় শুধুই শহর কলকাতা জায়গা করে নিল। তখন দিনগুলো ভাগ হয়ে যেত নির্দিষ্ট মানুষ, বন্ধুদের জন্য। এক দিন তোলা থাকত স্কুলের বন্ধুদের জন্য। আর এক দিন কলেজের বন্ধু-বান্ধব। কাজের দুনিয়ায় পা রাখলাম যখন, সেখানেও একদল বন্ধু বানিয়ে ফেললাম। ফলে, তাদের জন্যও একটি দিন নির্দিষ্ট হল। এ ছাড়া, পরিবারের সবার সঙ্গে বেরনো তো আছেই। দেখতে দেখতে আমার পুজো পাঁচ দিনের হয়ে গেল!
মায়ের পাড়া ম্যাডক্স স্ক্যোয়ার, আমার লবডঙ্কা!
‘মায়ের নজরদারিতে আমি কোনও দিন ম্যাডক্স স্কোয়্যারে গিয়ে ‘ম্যাড’ হতে পারলাম না!’
আমার ছোটবেলা কেটেছে হাজরায়। আমার মায়েরও পাড়া ওটা। মা-ও ছোট থেকে বড় হয়েছেন ওখানে। ফলে, ম্যাডক্স স্ক্যোয়ার মায়ের পাড়ার পুজো। আর আমার তাতেই বিপত্তি! বড় হলে সবাই এই একটি পার্কের মহিমা বোঝে। বিশেষ কারণে আকর্ষণও বাড়ে। একটা সময় যুগলদের কাছে স্ট্যাটাস সিম্বলও হয়ে ওঠে ওই পার্ক। আমার জীবনে সেটাই হল না। মায়ের নজরদারিতে আমি কোনও দিন ম্যাডক্স স্কোয়্যারে গিয়ে ‘ম্যাড’ হতে পারলাম না! আবার ওর আকর্ষণও এড়াতে পারতাম না। তাই দিনে অন্তত এক বার বন্ধুদের নিয়ে সেখানে যেতামই। আর গেলেই এক দল পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। এর মজাই আলাদা। সিংহী পার্কের ঠাকুর দেখতে গিয়েও একই ঘটনা ঘটত। পাঠভবনের দৌলতে ওটা আমার স্কুলের পাড়া। এই সূত্রে বলি, তথাকথিত পুজো স্পেশাল প্রেম আমার কোনও দিন হয়নি। বন্ধুনিদের সঙ্গে বন্ধুও থাকত। ধরুন, ১২ জনের একটি দলে ছ’জন ছেলে, ছ’জন মেয়ে। এই দল বুঝেশুনে বাছা হত। এই সুযোগে পছন্দের ‘বিশেষ বন্ধু’কে নিয়ে এক সঙ্গে বেশ কিছুটা হাঁটতে পারত তার প্রিয় বান্ধবী। রেস্তরাঁতেও বসা হত সে ভাবেই। অথচ কেউ, কাউকে বলেই উঠতে পারিনি আমরা।
পুজোর গন্ধ এসেছে...
গত কয়েক বছর পেশার দৌলতে আমি এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। এখন সব আড্ডা গিয়ে ঠেকেছে কোনও এক জন বন্ধুর বাড়িতে। এখন এমন বন্ধুর বাড়ি বাছা হয়, যেখানে আশপাশে পুজো মণ্ডপ থাকে। সেখান থেকে ভেসে আসে ঢাকের বাজনা, পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ। ওটাই আমার পুজোর আবহ। এ ভাবেই প্রবাসী বন্ধু, আত্মীয়দের সঙ্গে হইহই করতে করতে পাঁচটা দিন হুস করে যেন উড়ে যায়। সঙ্গে দেদার খাওয়াদাওয়া। পুজোর ভোগের খিচুড়ি, লুচি সাদা-আলুর তরকারি, নিরামিষের দিন নিরামিষ, আমিষের দিন আমিষ-- কিচ্ছু বাদ দিই না। কোনও একটা রাতে গাড়ি করে ঠাকুর দেখতে বের হই। গত বছর থেকে এই আনন্দেও থাবা বসিয়েছে অতিমারি। এ বছরেও তার রেশ থাকবে। সুতরাং, পুজোর আনন্দ বিশ বাঁও জলে।
পুজোর পার্বণে আমরা কিছু কিনব না, কী করে হয়!
পুজোয় চাই সব নতুন....
পয়লা বৈশাখ আর দুর্গা পুজো বাঙালির কেনাকাটার মরশুম। এই দুটো পার্বণে আমরা কিছু কিনব না, কী করে হয়! ছোটবেলায় সেই কেনাকাটার বহর দেখে তাক লেগে যেত। আমাদের প্রচুর আত্মীয় জামাকাপড় দিতেন। আমরাও সবাইকে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। সঙ্গে রোজ গোনা, ক'টা পুজোর জামা হল। এখন বছরভর কেনাকাটা, নয়তো কিছু না কিছু বানাতে দিচ্ছিই। ফলে, ‘শপিং’ আর বছরের দুটো দিনে সীমাবদ্ধ নেই। তবু, এ বছরের পুজোতেও মা জানতে চেয়েছেন, ‘কী নিবি পুজোয়’? ‘কেনাকাটা করবি না?'
আমি পুজোয় পাঁচ দিন শাড়ি পরতে ভালবাসি। চেষ্টাও করি সেটাই পরার। কারণ, শাড়ির এত প্রকার ভেদ যে সেখান থেকেই অনেক গুলো বেছে নেওয়া যায়, গুছিয়ে সাজাও যায়। স্বাদ বদলাতে হয়তো একটি দিনের এক বেলা ইন্দো-ওয়েস্টার্ন থাকলে আর এক বেলায় থাকবে কুর্তি। সাদা, লাল, কালো, নীল রং থাকবে পোশাক প্যালেটে। আর থাকবে মানানসই রুপোর গয়না, রঙিন কাজল।