মেঘেরা সব দেশেতেই এক। এক যোজন উপরের আকাশে ভাসতে ভাসতে দেখতে থাকে পৃথিবীকে। আর কবিদের কানে যায় সে খবর। ওয়ার্ডসওয়ার্থের মেঘ চোখ রেখেছিল‘আ হোস্ট অব গোল্ডেন ড্যাফোডিলস...’-এর সারিতে। মেঘদূতের কবি মেঘের চোখে দেখেছিলেন আসমুদ্রহিমাচল। বাঙালি জন্মকবি। শরতের মেঘ ভাসমান হলেই তার চোখে চোখ পাতে প্রবাসের বঙ্গসন্তান— দেখে নিতে চায়, বহুদূর ফেলে আসা কাশবন, তারা কি আজও শিশুর মতো আনন্দে দোলে আগমনীর সুরে!
মা আসছেন, বিশ্বব্যাপী তার আগমন। শরতের হাওয়ায় আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই মিশবে ঢাকের বোল। তৈরি হচ্ছে লণ্ডন। শহরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, কেন্টের সীমানায় বর্ধিষ্ণু, সবুজে ঘেরা জনপদ অর্পিংটন। কয়েক মাসব্যাপী পরিকল্পনা, জল্পনা, কল্পনা আর আড্ডা চলছে উৎসব ঘিরে—দলের নাম?সেটিও‘উৎসব’!আর কি-ই বা হতে পারত! অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ব্যাঙ্কারে সমৃদ্ধ এই দলে রয়েছে অবলীলায় জুতোসেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের রসদ। আর মা দুর্গা যেমন বঙ্গের, তেমনই তিনি সমগ্র ভারতের। তাই উৎসব টিমে পুরোমাত্রায় হাজির সবরমতী, তেলঙ্গানা, কলিঙ্গের প্রতিনিধিরাও। মর্ত্যের এ পাড়ায় মায়ের সিমলেস আপ্যায়নের লক্ষ্যে সবাই এক,কাঁধে কাঁধ। আর এ-ও ভুললে চলবে না যে মাতৃপরিচয় বাৎসল্যরসে, সুতরাং মাতৃদর্শনে যাঁরা আসবেন, তাঁদের আপ্যায়নও হওয়া চাই যথাযথ। তবেই তুষ্ট হবেন দশভুজা।
বিদেশে পুজোর মজা হল এই যে, এর পরিকল্পনা, পরিমার্জনা সবই চলমান— অর্পিংটন থেকে লন্ডন ব্রিজের রেলগাড়িতে বসে কেউ অষ্টোত্তরশত পদ্মের অর্ডার দিচ্ছেন অনলাইনে। আবার কেউ গাড়ির হ্যান্ডস-ফ্রিতে জেনে নিচ্ছেন কলকাতা থেকে আসন্ন পুরোহিতের ভিসার ছাড়পত্রটি এল কিনা সময় মতো। এখনও না এলে, যাকে বলে,‘একটু চাপ’। কেউ আবার উচ্চমানের বায়োডিগ্রেডেবল থালার সন্ধানে ব্যস্ত।এবারে ‘নো প্লাস্টিক’। তবে মহিষাসুরমর্দিনীর বরাভয় যেখানে, সেখানে দুশ্চিন্তার জায়গা বা প্রয়োজন, দুই-ই বাহুল্য। সেজন্য মহালয়ার এক্কেবারে ১২ দিন আগেই জমে উঠেছিল সর্বভারতীয় পেটপুজোর ব্যবস্থা—নাম‘দেশি তড়কা’।পাওভাজি, ফুচকা, বিরিয়ানি, জিলিপি, রসোগোল্লা, পিঠে— সব ডিপার্টমেন্ট কভারড। সেখানে হাজির আসমুদ্রহিমাচলের প্রতিনিধিরা, মেলালেন মা দুর্গা, যেমন তিনি মেলান।
দেখতে দেখতে এসে গিয়েছিল ফাইনাল মিটিং—ঝালমুড়ি-সহচা। অনেক এক্সেল শিট কাঁটাছেড়া হল শেষ বারের মতো। সব থেকে বড় কথা,সব ঠিক মতো হয়ে যাবে, হবেই।দশভুজার আশীর্বাদে ‘অল ইজ্ ওয়েল’।
অনেক ভালবাসা আর সাধনার ফসল প্রবাসের এই পুজো। বুকের মধ্যে একটু যাদবপুর, একটু কোচবিহার অথবা একটু বালিগঞ্জকে নিয়ে আসা দূরদেশের পাড়ায়, যে পাড়াটা ক’দিন আগেও ছিল অজানা, আর আজকে হয়েছে ঘর। আবার অঞ্জলির ভিড়, স্টলের শিঙাড়া, আরতির ধোঁয়ার আড়ালের ত্রিলোচন— এইসব অনুষঙ্গের হাত ধরে হঠাৎ সব ছেড়ে হু হু করে মন চলল বাংলার টানে। এই নিয়েই প্রবাসী পুজো। সবাই আসবেন ৫, ৬, ৭ অক্টোবর, ক্রফটন হলে— একসঙ্গে হবে আবাহন।