ভোট প্রচারে উত্তর মুম্বইয়ের বিজেপি প্রার্থী পীযুষ গয়াল। বুধবার। ছবি: পিটিআই।
ভোর থেকে অবিরাম দৌড়ে যাওয়ার পরেও শেষ রাত পর্যন্ত জেগে থাকে আরব সাগরের পাশে এই শহর। তবে এই দ্রুতির মধ্যেও মেরিন ড্রাইভে বিখ্যাত সূর্যাস্ত দেখতে ভিড় উপচে পড়ছে রোজই। যুগলে তো বটেই, ব্যাগ পাশে রেখে গলদঘর্ম একাকী মানুষটিও বসে পড়েছেন সমুদ্রের দিকে মুখ করে। চা আর বড়া পাও-এর বিরতিতে ডুবন্ত সূর্যের সঙ্গে সেলফি তুলছেন।
সামনেই দিল্লির তখ্ত দখলের ভোটদান। কিন্তু মহারাষ্ট্রের বাতাসে ভোটের প্রশ্ন অন্য। ঠিক ৩৯ বছর আগে মরাঠার রাজনীতিতে যে নতুন সূর্যোদয় ঘটেছিল তৎকালীন বম্বে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ৭৫টি আসন দখল করে, সেই বালাসাহেব ঠাকরের পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির সূর্য আরব সাগরে অস্তমিত হবে, না কি ফের ঘুরে দাঁড়াবে? শেয়ারবাজারের অতি ব্যস্ত দালাল থেকে বড়া পাও-এর প্রবীণ বিক্রেতা—এই প্রশ্নের নাগরদোলায় ঘুরপাক খাচ্ছেন সবাই।
মেরিন ড্রাইভ থেকে সামান্য দূরেই চার্চ গেটের কাছে বালাসাহেব ভবন। একতলা পুরনো আমলের এই বাংলোটির ঘরে ঘরে সর্বত্র তাঁর ছবি। তবে তাঁর সঙ্গে একমুখ দাড়ি, কপালে তিলক কাটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরা একনাথ শিন্দের ছবিও একই সাইজের। সামান্য ছোট-বড়ও নয়! আসল বা নকল, নতুন বা পুরনো, আদি ও অধুনা—যে ভাবেই বলা যাক, দু’ভাগে ভাগ হওয়া শিন্দের লড়াইয়ে বালাসাহেবের নামাঙ্কিত অফিস একটি ‘ওয়াররুম’ এখন।
এ বার বিজেপির সঙ্গে দরকষাকষি করে মহারাষ্ট্রের মোট ৪৮টি আসনের মধ্যে যে পনেরোটিতে লড়ছে শিন্দেপন্থী শিবসেনা, তার মধ্যে ১৩টিতেই তাদের মুখোমুখি লড়াই উদ্ধবপন্থী শিবসেনার সঙ্গে। ‘‘পঁচানব্বই সালে মরাঠাপ্রদেশে বিজেপি-র সঙ্গে হাত ধরে বালাসাহেব ঠাকরে কংগ্রেসের আধিপত্য খর্ব করেছিলেন। মুম্বা দেবীর সম্মানে শহরের নাম বদলে হয়েছিল মুম্বই। বালাসাহেবের মৃত্যুর পর তাঁর অযোগ্য পুত্র উদ্ধব সনিয়া গান্ধীর পায়ের কাছে দলের গৌরবময় প্রতীক তির-ধনুক নামিয়ে রেখেছিলেন। শিন্দেজি সেই হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করেছেন মাত্র’’, বলছেন কিরণ পাওস্কর।
শিন্দেপন্থী শিবসেনার অন্যতম সেনাপতি কিরণ। বলছেন, ‘‘খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন উদ্ধব যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, বালাসাহেবকে হিন্দু হৃদয়সম্রাট কথাটাই বলতেন না ভুলেও। গান্ধী পরিবার বারণ করে দিয়েছিল বলে। এখনও মুসলমান ভোটের জন্য বালাসাহেবের আদর্শের সঙ্গে সমঝোতা করছেন তাঁর পুত্র। অথচ শিন্দে গত দু’বছরের মধ্যে পরিকাঠামোক্ষেত্রে যে কাজ শুরু করেছেন, তাতে সব সম্প্রদায়ের মানুষই লাভবান হচ্ছেন। উদ্ধব তো তাঁর নিজের দলের বিধায়কদের সঙ্গেও দেখা করতেন না। বাইরে থেকে শান্ত মনে হলেও কাছ থেকে যাঁরা তাঁকে দেখেছে, তাঁরাই জানেন, খুবই
উদ্ধত উদ্ধব।’’
উদ্ধবের বিরুদ্ধে এই ভাষ্য এবং তার পাশাপাশি গত দু’বছরে শিন্দে-মোদীর ডাবল ইঞ্জিনে মহারাষ্ট্রের পরিকাঠামোয় জোয়ার আসার গল্প। ১৩টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আসনে এই দু’টি বিষয়কেই সামনে নিয়ে আসছে শিন্দে শিবির। দলের আর এক নেতা মোহন দেশাইয়ের কথায়, ‘‘মেট্রো রেলের কাজ, অটল সেতু, কোস্টাল রোড, সংশ্লিষ্ট সমস্ত পরিকাঠামোর কাজ উদ্ধবের সময়ে ধামাচাপা পড়েছিল। এখন মেট্রোর কাজ শেষ, বুলেট ট্রেনের কাজ শুরু। বালাসাহেব শুরু করেছিলেন বিনা মূল্যের দাওয়াখানা। উদ্ধবের সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর তহবিল থেকে দেওয়া হত বছরে আড়াই কোটি টাকা করে। রাজ্য সরকারের তরফ থেকে ১৮৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে এই চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে। নবি মুম্বইয়ে নতুন বিমানবন্দর চালু হয়ে যাবে এক বছরের মধ্যে। যে ভাবে পরিকাঠামো বাড়ছে, চাকরির সুযোগও বাড়ছে। বেকারত্ব মহারাষ্ট্রে মহাবিকাশ আগাড়ির মিথ্যা প্রচার ছাড়া কিছু নয়।’’ তাঁর দাবি, বাণিজ্য মডেল বদলাচ্ছে মহারাষ্ট্রে। উৎপাদন শিল্পের থেকে বেশি কাজ জুটছে আইপিও বিপিও তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে। হিসাব দেওয়া হচ্ছে, আগে মুম্বইয়ে ছিল ৫টি বড় পাঁচতারা হোটেল, এখন তার সংখ্যা একুশ। প্রধানমন্ত্রী নবীন উদ্যোগ চালু হওয়ায় স্বনিযুক্তিতে অনেকটাই এগিয়েছে আজকের মহারাষ্ট্র।
মহারাষ্ট্রের বিজেপি শাখা অবশ্য মোদীর হিন্দুত্বকেও, উন্নয়নের সমান গুরুত্বের সঙ্গেও সামনে আনছে। মুখপাত্র সন্দীপ খরদেকর বলছেন, ‘‘একমাত্র অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ছাড়া আমাদের যুবা আন্দোলনের সময়ের সমস্ত স্বপ্ন পূরণ করেছেন মোদী। কেউ (পাকিস্তান) চোখ তুলে দেখতে সাহস করে না। গত দশ বছরে দেশের কোথাও সন্ত্রাসবাদী হামলা নেই। ৫০০ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে রামমন্দির নির্মাণ হয়েছে।’’
বিজেপি এবং শিন্দেপন্থী সৈনিকদের যৌথ দাবি, রাজ্যের দল ও সামাজিক সংস্থা এক ছাতার তলায় এসেছে। রামদাস অটওয়ালের রিপাবলিকান পার্টি, যোগেন্দ্র কাওয়াড়ের বিদর্ভ পার্টি, অখিল ভারতীয় মরাঠা মহাসংঘ, ওবিসি ভুক্ত ধনগড় সমাজ, মাতঙ্গ দলিত সমাজ সবাই যোগ দিয়েছে বিজেপি-শিন্দেপন্থী সৈনিকদের সঙ্গে।
বাকি রইল, শিবসেনার আদি প্রতীক এবং বিধায়ক, সাংসদদের ভাঙিয়ে নিয়ে শিন্দের নতুন শিবসেনা করার অভিযোগ। শিন্দে শিবিরের যুক্তি, যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদ, বিধায়ক, কর্পোরেটর নেতা ছেড়েই চলে যান, তা হলে আর পুরনো দলের অস্তিত্বই থাকে কোথায়? মহারাষ্ট্র বিধানসভা, নির্বাচন কমিশন এবং সুপ্রিম কোর্ট যে দল এবং প্রক্রিয়ায় সিলমোহর দিয়েছে, সেখানে ‘চুরির’ অভিযোগ আসছে কী ভাবে?
সেনা বনাম সেনার এই লড়াই
এ ভাবেই এখন অন্তিম পর্বের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy